প্রসবজনিত ফিস্টুলা রোগীর চিকিৎসার অনন্য প্রতিষ্ঠান

টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার মহাদাস গ্রামের মজিবর রহমানের স্ত্রী নাছিমা বেগম (৫৫) ২০ বছর আগে প্রসবজনিত ফিস্টুলা (ভিভিএফ) রোগে আক্রান্ত হন। বিভিন্ন ওষুধ খাওয়ার পর এখন তিনি টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের কুমুদিনী হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে অনেকটা সুস্থ।

হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে নাছিমা বেগম এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘দুইডা পোলাহান অওনের পর মারা যায়। বিয়ার ১০ বছরের মাতায় তিন নম্বরডা যহন অয়, তহন যানি আমার কী অয়্যা যায়। বাচ্চাডা তো মইর‌্যা যায়। বাচ্চা অওনের কিছুদিন পর থিক্যা আমার পেশাবের রাস্তা দিয়্যা গন্ধ বের অয়। ওষুধ খাই, কাজ অয় না। আমারে থুয়্যা স্বামী বিয়া করে। বিয়ার ১৩ বছর পর হেই যে বাপে স্বামীর বাড়ি থিক্যা নিয়্যা আইল, তারপর আর আমারে স্বামী ন্যাই নাই; আমিও য্যাই নাই। আর ২০ বছর পর হাসপাতালে চিকিৎসা নিতাছি। অহন গন্ধ আহে না। মনে অয় ভালো অয়্যা যামু।’

হাসপাতাল সূত্র জানায়, কুমুদিনী হাসপাতালে প্রায় ১৩ বছর ধরে বিনা মূল্যে ভিভিএফ রোগের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার (ইউএসএআইডি) আর্থিক সহায়তা ও এনজেন্ডারহেলথ বাংলাদেশের কারিগরি সহায়তায় এ পর্যন্ত ৬২৭ জন রোগীকে হাসপাতালটিতে বিনা মূল্যে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।

হাসপাতাল সূত্রমতে, জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল কার্যক্রমের (ইউএনএফপিএ) অর্থায়নে এনজেন্ডারহেলথ বাংলাদেশ ২০০৩ সালে বাংলাদেশের নারীদের বিলম্বিত ও বাধাগ্রস্ত প্রসবের কারণে সৃষ্ট ক্ষতের মধ্য দিয়ে প্রসবপথে প্রস্রাব বা পায়খানা ঝরতে থাকা বা ভিভিএফ পরিস্থিতির ওপর জরিপ চালায়। এতে সংস্থাটি প্রতি তিন হাজার বিবাহিত নারীর মধ্যে পাঁচজন ভিভিএফ রোগী পায়। ২০০৫ সালের জুলাইয়ে কুমুদিনী হাসপাতালসহ দেশের তিনটি বেসরকারি হাসপাতাল ভিভিএফ রোগীদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের জন্য কাজ শুরু করে। তবে কুমুদিনী হাসপাতালে এ রোগের চিকিৎসা আগে থেকেই করা হতো।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, ভিভিএফ রোগের চিকিৎসার জন্য কুমুদিনী হাসপাতালে সার্বক্ষণিক দুজন চিকিৎসক নিয়োজিত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে হাসপাতালের সাবেক পরিচালক দুলাল চন্দ্র পোদ্দার গত বছর অন্যত্র চলে যান। বর্তমানে কুমুদিনী মেডিকেল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক বিলকিস বেগম চৌধুরী একাই দায়িত্ব পালন করছেন। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর বিশেষ চিকিৎসক দল দুবার এবং উগান্ডার দুজন চিকিৎসক একাধিকবার বিনা মূল্যে রোগীদের চিকিৎসা দিয়েছেন।

জানা গেছে, কুমুদিনী হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা ফিস্টুলা রোগীর বেশির ভাগই স্বামী থেকে বিচ্ছিন্ন ও দরিদ্র পরিবারের। এ প্রসঙ্গে সহযোগী অধ্যাপক বিলকিস বেগম চৌধুরী বলেন, ‘টাকার অভাবে অনেকে চিকিৎসা করাতে পারেন না। ক্ষতস্থান থেকে দুর্গন্ধ বের হওয়ার কারণে প্রতিবেশীসহ স্বামী-সন্তানদের সামনেও যেতে পারেন না। চিকিৎসার পর সুস্থ হলে তাঁদের মধ্যে অন্য রকম ফিলিংস (অনুভূতি) কাজ করে। আমি নিজেও প্রশান্তি পাই। এ ছাড়া একা চিকিৎসা করাতে আমার কোনো সমস্যা হয় না।’

বিনা মূল্যে চিকিৎসা নিতে আসা এসব রোগীর কুমুদিনী হাসপাতাল থেকে থাকা-খাওয়া, যাতায়াতের ব্যবস্থা করা হয়। যিনি রোগী নিয়ে হাসপাতালে আসেন, তাঁরও যাতায়াতের খরচ দেওয়া হয়। এ ছাড়া কেউ রোগী পাঠালে তাঁকেও সম্মানী (রেফারেন্স ফি) হিসেবে ৫০০ টাকা দেওয়া হয় বলে হাসপাতাল সূত্র জানায়।

১০ বছর আগে স্বাভাবিক প্রসবের মাধ্যমে প্রথম সন্তান জন্ম দেওয়ার সময় ফিস্টুলায় আক্রান্ত হন দেওহাটা গ্রামের সোলাইমান মিয়ার স্ত্রী শিল্পী। রোগটি সম্পর্কে কিছু বুঝে ওঠার আগেই দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম দেন তিনি। কিন্তু তাঁর সমস্যা বাড়তেই থাকে। তিনি বলেন, ‘স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীদের পরামর্শে এক বছর আগে কুমুদিনী হাসপাতালে চিকিৎসা নিই। এখন আমি আগের চেয়ে অনেক সুস্থ আছি। হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আমার কোনো খরচও হয়নি।’

হাসপাতালের সিনিয়র প্রোগ্রাম অফিসার মো. আবদুল হাই বলেন, ভিভিএফ চিকিৎসার শুরুর দিকটা খুবই কষ্টের ছিল। তবে এখন মানুষ অনেক সচেতন। হাসপাতালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রথম অপারেশনে ৮০ শতাংশ রোগী সুস্থ হয়েছেন। অন্যদের একাধিকবার অপারেশন করতে হয়েছে। তিনি আরও বলেন, আগে স্বাভাবিক সন্তান জন্মদানের কারণে রোগটি হলেও এখন সিজারিয়ান ও হিস্টেরেকটমি অপারেশন বেশি হওয়ায় আইটেজনিক (যন্ত্রের মাধ্যমে অপারেশন করতে গিয়ে জরায়ু ছিদ্র করে ফেলা) ফিস্টুলা হচ্ছে। এ বিষয়ে চিকিৎসকদের সচেতন হতে হবে।’

কুমুদিনী হাসপাতালের পরিচালক প্রদীপ কুমার রায় জানান, ভিভিএফ রোগীর চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সব সময় সচেষ্ট রয়েছে। রোগটি যাতে না হয়, সে জন্য সবার সচেতন হওয়া জরুরি।