'সুদের টাকা দিতে দিতে ফতুর হয়ে গেলাম'

হাটে ধান তুলেছেন, কিন্তু কৃষকের মন খারাপ। নওগাঁর তেঁতুলিয়া হাটে।  ছবি: প্রথম আলো
হাটে ধান তুলেছেন, কিন্তু কৃষকের মন খারাপ। নওগাঁর তেঁতুলিয়া হাটে। ছবি: প্রথম আলো

বেশি পরিমাণে বোরো ধানের আবাদ হওয়ায় নওগাঁ জেলাকে স্থানীয় লোকজন গর্ব করে বলেন ‘ধানের রাজধানী’। বগুড়ার সান্তাহার রেলস্টেশন থেকে ভোরবেলায় নছিমনে করে নওগাঁ সদরের দিকে এগোতে কৃষকের সদ্য কাটা ধানের গন্ধ পেলাম। আর সড়কের দুই পাশে সারি সারি চালকল চোখে পড়ল। চালকলের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে নছিমনচালক বলে উঠলেন, ‘এসব দেখে লাভ নেই কোনো, ধানের রাজ্যে মড়ক লাগিছে। ধান কাটা শুরু হলে নওগাঁ জাগি ওঠে, আর এবার পুরা শহর ঝিমাচ্ছে। ধানের দাম কবে বাড়বে?’ এই প্রশ্ন ছুড়ে দেন ওই তরুণ।

ধানের দাম কমে যাওয়ায় কেমন আছেন কৃষক, চাল ব্যবসায়ী ও চালকলমালিকেরা? গত বুধবার নওগাঁর সরকারি সংস্থা, কৃষক ও চাল ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এবার জেলার ৯০ শতাংশের বেশি কৃষক সরকারের ধান-চাল সংগ্রহের উদ্যোগ থেকে কোনো সুবিধা পাচ্ছেন না।

মূলত আমদানির চাল কৃষকের বাম্পার উৎপাদনের খুশিকে যে ম্লান করে দিয়েছে, তা নওগাঁ শহরে পৌঁছানোর ১৫-২০ মিনিটের মধ্যেই পরিষ্কার হলো। জেলা সার্কিট হাউস মোড় থেকে পাঁচ কিলোমিটার এগোতেই একটি বন্ধ হওয়া চালকলের সামনে চোখ যায়। বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষ মিলে ধানমাড়াই করছেন।

কাছে গিয়ে জানা গেল, তাঁরা সবাই একই পরিবারের সদস্য। আবদুল জব্বার ও তাঁর স্ত্রী জমিলা বেগম, বড় মেয়ের স্বামী দেলোয়ার হোসেন, নাতি-নাতনি সবাইকে নিয়ে ধানমাড়াই করছেন তাঁরা। এক বেলা একজন শ্রমিকের মজুরি ৭০০ টাকা। তা দেওয়ার ক্ষমতা জব্বারের নেই। এক মণ ধান ফলাতে খরচ পড়েছে ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকা। আর তা বিক্রি হচ্ছে ৫০০ টাকা। এসব তথ্য বলতে বলতে জব্বারের স্ত্রী স্বামীর গায়ের মলিন হওয়া শার্টটি সরিয়ে দিয়ে বলেন, ‘দেখেন এই বয়সে ধান কাইটতে, বই (বয়ে) আনতে গায়ে ফোসকা পড়ি গেছে।’

জব্বার ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলতে শুরু করেন, ‘দেখেন, ধান কাটা হলি পরে মেয়ের জামাইরে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে আসি। তাদের জন্যি ভালো-মন্দ খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করি। আর এবার ধান কাটতি তাদের নিয়ে আইসছি। ঈদে তাদের জামাকাপড় দেওত তো দূরে থাক, পেটে দুইটা ভাত জোগাড় করাই কষ্ট হয়ে যাবি।’

>৯০ শতাংশের বেশি কৃষকই তাঁদের ধান সরকারি গুদামে বিক্রি করতে পারবেন না
এভাবে চললে নওগাঁর কৃষক ধান ছেড়ে আম আর লিচুতে চলে যাবে

কৃষক জব্বারের এসব কষ্ট আর যন্ত্রণার কথা শুনে আরও কিছুদূর এগোতেই শুরু হলো শত শত চালকলের সারি। বিশাল এলাকা নিয়ে গড়ে ওঠা এসব চালকলের প্রায় সব কটিই বন্ধ। জেলার বেশির ভাগ বোরো ধান কাটা শেষ। কৃষক ধান নিয়ে এই হাট ওই হাট ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু বিক্রি হচ্ছে না। যদি বিক্রি হয়, তা-ও কোথাও ছয় শ টাকার ওপরে দাম নেই। গত বছরই এসব ধান ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা মণ দরে বিক্রি হয়েছে। এবার চালকল, ব্যবসায়ী কেউ ধান কিনছেন না।

নওগাঁ সদরের হাপানিয়া এলাকার একটি সড়কের দুই পাশের শ দেড়েক চালকলের মধ্যে মাত্র একটি খোলা পাওয়া গেল। মেসার্স আতিক রাইস মিল নামের ওই চালকলটির মূল মালিক তা চালাতে না পেরে ইজারা দিয়ে দিয়েছেন। আর তা নিয়েছেন স্থানীয় চাল ব্যবসায়ী মোতাহার হোসেন। ধান-চালের দাম তো কম, আপনাদের ব্যবসা তো ভালোই হচ্ছে, এই প্রশ্ন করতে তিনি উল্টো প্রশ্ন করেন, ‘দাম তো কম বুঝলাম। কিন্তু চাল বিক্রি না হলে কী হবে? ব্যাংক থেকে ৫০ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে গত আমনে ধান কিনেছি, এখনো ৭০ শতাংশ ধান রয়ে গেছে। বোরো কীভাবে কিনব। এদিকে সুদের টাকা দিতে দিতে ফতুর হয়ে গেলাম।’

ধান কেন বিক্রি হচ্ছে না, তা জানতে গেলাম সদর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে তেঁতুলিয়া হাটে। কৃষকের কাছ থেকে ৬০০ থেকে ৬২০ টাকা মণ করে মাঝারি মানের জিরাশাইল ধান ও ৫০০ টাকা মণ দরে মোটা ধান কিনে বস্তায় ভরছিলেন ধান ব্যবসায়ী হাসান আলী। তিনি জানান, গত বছর এই ধান বিক্রি হয়েছে ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা মণ।

কৃষকের কাছ থেকে ধান তো কম দামে কিনছেন। সরকারি গুদামে তো এই ধান ১ হাজার ৪০ টাকা কেজি দরে দেবেন। লাভ তো ভালোই থাকছে। এই প্রশ্ন করতেই কিছুটা উত্তেজিত হয়ে গেলেন হাসান আলী ও তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সোহেল রানা। তিনি বলেন, ‘সরকার একজনের কাছ থেকে এক টনের বেশি ধান কিনছে না। আর সরকারি তালিকায় নাম লেখাতে কত জায়গায় কত টাকা দিতে হয়, সেই খবর রাখেন?’

হাসান আলী ও সোহেল রানার কথায় খাদ্য অধিদপ্তরের ধান-চাল সংগ্রহে অনিয়ম ও দুর্নীতির ইঙ্গিত বুঝতে পেরে আর কথা বাড়ালাম না।

খাদ্য নিয়ন্ত্রক হিসেবে এক সপ্তাহ হলো দায়িত্ব নিয়েছেন টাঙ্গাইল থেকে বদলি হয়ে আসা জি এম ফারুক হোসেন পাটওয়ারি। নওগাঁ জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ে তাঁর সামনে উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকেরা বসে আছেন। একটি রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তাও সেখানে বসা, খাদ্য বিভাগের লোকেরা তাঁর কাছে ধান-চাল সংগ্রহের তথ্য দিচ্ছিলেন।

জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক জানান, এ বছর এই জেলা থেকে ৭২ হাজার ৯৬ মেট্রিক টন চাল সংগ্রহের জন্য বরাদ্দ রয়েছে। ইতিমধ্যে ৫ হাজার ৬৩২ টন চাল তাঁরা সংগ্রহ করেছেন। ১ হাজার ২৯টি চালকলের সঙ্গে তাঁরা চুক্তি করেছেন। এর মধ্যে অটো মিল হচ্ছে ৫৪টি, বাকিগুলো হাসকিং ও অন্যান্য। আর ধান সংগ্রহ করা হবে ৫ হাজার ৫৮৬ টন। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী একেকজন কৃষকের কাছ থেকে তিন টন করে ধান সংগ্রহ করার কথা। বেশি কৃষকের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ করতে তাঁরা কৃষকপ্রতি এক টন করে ধান সংগ্রহ করছেন।

জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কথার সত্যতা জানতে হাজির হলাম সরকারি খাদ্যগুদামে। সেখানে আলাদা একটি গুদামে ধান সংগ্রহ হতে দেখা গেল। নছিমন ও ছোট কাভার্ড ভ্যানে করে কৃষকেরা ধান নিয়ে আসছেন। গুদামের সামনে খোলা জায়গায় দেখা গেল, এক কৃষক তাঁর নিয়ে আসা ধান ঝাড়ছেন ও রোদে শুকাচ্ছেন। খাদ্যগুদামের লোকেরা বলেছেন, ধানে বেশি আর্দ্রতা, চিটাও বেশি। এই ধান বাড়ি নিয়ে যাওয়ার মতো ভাড়ার টাকাও ওই কৃষকের কাছে নেই। তাই শুকিয়ে ঝেড়ে যতটুকু টেকে, ততটুকুই বিক্রি করবেন বলে জানান।

নওগাঁ সদরের দুবলার কাঠি থেকে ধান নিয়ে আসা কৃষক আইনুল হক জানান, তাঁর জমিতে ধান হয়েছে ২৩০ টন। আর সরকার তাঁর কাছ থেকে ১ হাজার ৪০ টাকা দরে নিচ্ছে মাত্র এক টন। বাকি ধান তিনি ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা মণ দরে বিক্রি করছেন জানিয়ে বলেন, ‘সরকারি গুদামে চাল দেওয়া আর কৃষকদের লোকসানের সাগর থেকে এক বালতি পানি সরানো একই।’

দেশের অন্যতম বোরো ধান উৎপাদনকারী জেলা নওগাঁর কত কৃষক ধান চাষ করেন, সেই হিসাব জানতে হাজির হলাম জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে। অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী জেলায় প্রায় ৬৬ হাজার কৃষকের কাছ থেকে বোরো মৌসুমে প্রায় ১২ লাখ টন ধান আসে। আর সরকার যদি একজন কৃষকের কাছ থেকে এক টন করে ধান কেনে, তাহলে ৫ হাজার ৫৮৬ জন কৃষক সরকারি গুদামে ধান দিতে পারবেন। অর্থাৎ ৯০ শতাংশের বেশি কৃষকই তাঁদের ধান সরকারি গুদামে বিক্রি করতে পারবেন না।

জানতে চাইলে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা চাই কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি আরও বেশি পরিমাণে ধান কিনতে চাই। কিন্তু সরকারের খাদ্য সংগ্রহ জাতীয় কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দেড় লাখ টন ধান কেনা হবে। আমি এককভাবে এই সিদ্ধান্ত বদলাতে পারি না। তবে যেসব চালকল চুক্তি অনুযায়ী নির্দিষ্ট পরিমাণে চাল দিতে পারবে না, তাদের চুক্তি আমরা বাতিল করব। এর বদলে সমপরিমাণ ধান কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি কিনব। আমরা সারা দেশে ১০ লাখ টন ধান মজুতের গুদাম নির্মাণ করছি।’

আমদানির চালের কারণে ধানের বাজার পরিস্থিতি ভালো নয় বলে মনে করেন নওগাঁ চালকল মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন চকদার। তিনি বলেন, ‘বছরে নওগাঁ জেলার ধানের চাহিদা মিটিয়ে প্রায় ১২ লাখ টন আশপাশের জেলাগুলোতে সরবরাহ করি। সেখানে ১ হাজার ২০০ চালকলের মধ্যে বড়জোর ২০০টি চালু আছে। এক বছর ধরে বাজার দখল করে ছিল আমদানি করা চাল। ওই চালের চালবাজিতে আমরা সব নিঃস্ব। প্রায় সব মিল দেনার দায়ে বন্ধ, ব্যাংক নতুন করে আর ঋণ দিচ্ছে না। কিন্তু আমদানিকারকেরা ঠিকই ঋণ পাচ্ছে। এভাবে চললে নওগাঁর কৃষক ধান ছেড়ে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের মতো আম আর লিচুতে চলে যাবে। আর আমরা ধান-চালের ব্যবসা বাদ দিয়ে ফল ব্যবসা করব। কৃষক ও চালকলের মালিকদের এমন অবস্থায় রেখে কীভাবে দেশের মানুষকে তিন বেলা ভাত খাওয়াবে সরকার?’