জিপিএ-৫ পাওয়া দিনমজুর মারুফ চিকিৎসক হতে পারবে?

বাবা এমদাদুল ইসলাম ও মা মাহামুদা বেগমের সঙ্গে মারুফ ইসলাম। ছবি: প্রথম আলো
বাবা এমদাদুল ইসলাম ও মা মাহামুদা বেগমের সঙ্গে মারুফ ইসলাম। ছবি: প্রথম আলো

নুন-পান্তার সংসারে নিত্য টানাটানি। পরিবারের হাল ধরেছেন মা, কারণ অসুস্থ বাবা কাজ করতে পারেন না। কিন্তু মায়ের একার আয়ে চলে না পাঁচজনের সংসার। তাই মারুফ কখনো হয় দিনমজুর, কখনো রাজমিস্ত্রির সহকারী। কিন্তু পড়াশোনায় হাল ছাড়েনি সে। আধপেটা থেকেই চালিয়ে গেছে স্কুল। এই কষ্টের ফল হলো, এসএসসিতে জিপিএ-৫। কিন্তু তা–ও মারুফের মুখে হাসি ফোটেনি।

হাসি ফুটবেই বা কী করে? সাধ আর সাধ্যে যে যুদ্ধ লেগেছে! মারুফের স্বপ্ন—পড়াশোনা চালিয়ে শেষে চিকিৎসক হবে। কিন্তু দারিদ্র্য তাতে বাধার দেয়াল গড়েছে। সেই দেয়ালের ইট-সিমেন্টের বাঁধুনি বড়ই শক্ত। রাজমিস্ত্রির সহকারী মারুফ তা ভাঙতে পারছে না।

মারুফের পুরো নাম মারুফ ইসলাম। রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার ইকরচালী ইউনিয়নের সরকারপাড়া গ্রামের দিনমজুর এমদাদুল ইসলামের ছেলে সে। সংসার ও লেখাপড়ার খরচ জোগাতে কখনো দিনমজুরি আবার কখনো রাজমিস্ত্রির সহকারী হিসেবে কাজ করেছে মারুফ। অন্যের দেওয়া জামা পরে, প্রায় দিন না খেয়ে স্কুল যেতে হয়েছে তাকে। কিন্তু কোনো প্রতিবন্ধকতাই তাঁর স্বপ্ন দেখায় বাধা হতে পারেনি। তারাগঞ্জ উপজেলার ইকরচালী উচ্চবিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে পরীক্ষা দিয়ে এবারের এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে সে। লেখাপড়ার খরচ কীভাবে চালিয়ে নেবে—মারুফ এখন তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছে।

ইকরচালী ইউনিয়নের ইউপি সদস্য রবিউল ইসলাম বলেন, মারুফদের পরিবারের অবস্থা এতই করুণ যে ঠিকমতো দুই বেলার খাবার জোটে না। মারুফের মায়ের নামে এবার ভিজিডি কার্ড করে দেওয়া হয়েছে।

পরিবার, জনপ্রতিনিধি ও শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উপজেলা সদর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে সরকারপাড়া গ্রামে মারুফদের বাড়ি। সহায় সম্বল বলতে বসতভিটার তিন শতক জমির ওপর একটা দোচালা ভাঙাচোরা টিনের ঘর। সেখানে কোনোমতে মাথা গুঁজে থাকে তিন ভাইবোন ও বাবা-মা। মারুফের বাবা এমদাদুল ইসলাম দীর্ঘদিন ধরে হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ। অর্থাভাবে চিকিৎসা করাতে পারছেন না। মারুফের মা মাহামুদা বেগম অন্যের বাড়িতে কাজ করে যা আয় করেন, তা দিয়ে দুই বেলার খাবারই জোটে না।

ইকরচালী উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘গরিব ঘরের ছেলে মারুফ সত্যি মেধাবী। সে অষ্টম শ্রেণিতেও জিপিএ-৫ পেয়েছিল। দারিদ্র্য তাকে আটকাতে পারেনি। আমাদের স্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেওয়া ১৩৮ জনের মধ্যে একমাত্র জিপিএ-৫ পেয়ে সবার মুখ উজ্জ্বল করেছে মারুফ।’

মায়ের একার আয়ে চলে না সংসার। তাই মারুফ কখনো হয় দিনমজুর, কখনো রাজমিস্ত্রির সহকারী। ছবি: প্রথম আলো
মায়ের একার আয়ে চলে না সংসার। তাই মারুফ কখনো হয় দিনমজুর, কখনো রাজমিস্ত্রির সহকারী। ছবি: প্রথম আলো

গতকাল শুক্রবার মারুফের বাড়িতে গিয়ে চোখে পড়ে সুনসান নীরবতা। কেউ নেই। ঘরের ভেতরে দুটি চৌকি পাতা, নেই কোনো চেয়ার-টেবিল। প্রতিবেশীদের কাছ থেকে জানা গেলে, জিপিএ-৫ পাওয়া মারুফ ধান কাটতে গেছে। সেখানে গিয়ে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। মারুফ বলে, ‘বাবা অসুস্থ। কাজ করতে পারে না। মা কষ্ট করে সংসার চালান। আমি কখনো দিনমজুরি, আবার কখনো রাজমিস্ত্রির সহকারী হিসেবে কাজ করে সংসারে সহায়তার পাশাপাশি পড়ার খরচ চালিয়েছি। আমার ইচ্ছা পড়ালেখা করে ডাক্তার হব।’

এর পরের প্রশ্নেই ধরা পড়ে মারুফের আশঙ্কা। চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্নে বিভোর মেধাবী মারুফের প্রশ্ন, ‘অভাবের সংসারে সেটা কি সম্ভব?’একই প্রশ্ন মারুফের মা মাহমুদা বেগমেরও। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছাওয়াটাক তো পেটভরে খাবারে দিবার পাও না। ক্যামন করি পড়াইম কন?’

তারাগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মারুফের বাবার কোনো আবাদি জমি নেই। তিন শতক বসতভিটাই সম্বল। মারুফ অনেক কষ্টে পড়াশোনা করছে।

মারুফের স্বপ্ন সত্যি করতে চাইলে:
বিকাশ নম্বর: ০১৭৫১০৯৫৯৬৪