সম্পর্ক আরও সংহত করতে জাপান সফরে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ফাইল ছবি
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ফাইল ছবি

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৮ মে সরকারি সফরে জাপান আসছেন। তিন দিনের এই সফরে তিনি জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় শীর্ষ বৈঠকে অংশ নেবেন। এ ছাড়া জাপানের প্রভাবশালী দৈনিক নিক্কেই শিম্বুনের আয়োজিত ‘এশিয়ার ভবিষ্যৎ’ শিরোনামের এক আন্তর্জাতিক ফোরামে অন্যতম প্রধান বক্তা হিসেবে ভাষণ দেবেন শেখ হাসিনা। 


বাংলাদেশের স্বাধীনতার সূচনালগ্ন থেকেই প্রধান এক শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে দেশটির পাশে থেকেছে জাপান। দুর্দিনে জাপান সব সময় সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশকে দেওয়া বৈদেশিক উন্নয়ন সাহায্যের বেলায় দাতাদেশগুলোর তালিকায় শুরু থেকেই শীর্ষে জাপানের অবস্থান। বিশেষ করে বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নে জাপানের সহায়তা নজিরবিহীন।

চলমান সেই সহায়তার সাম্প্রতিক একটি মাইলফলক ঢাকার মেট্রোরেল প্রকল্প, যে প্রকল্পের কাজ শেষ হলে বাংলাদেশের রাজধানীর যানজট সমস্যা সহজ হয়ে আসা ছাড়াও নগর পরিবহনব্যবস্থায় যুগান্তকারী পরিবর্তন আসবে বলে অনেকেই মনে করছেন। অবকাঠামো ছাড়া কৃষি খাতেও জাপানের সহায়তা হচ্ছে সাফল্যের আরেকটি দৃষ্টান্ত। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় জাপানের উন্নয়ন সাহায্য অবশ্য বাংলাদেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবাসহ অন্যান্য খাতেও সম্প্রসারিত হয়েছে। ফলে, জাপান হচ্ছে বাংলাদেশের পরীক্ষিত এক অকৃত্রিম বন্ধু। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর আসন্ন জাপান সফরে এই সম্পর্ককে আরও এগিয়ে নেওয়ার প্রত্যাশায় জাপানের বিনিয়োগকারীদের প্রতি বেশি করে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাবেন।

জাপান এসে পৌঁছানোর এক দিন পর ২৯ মে টোকিওতে ব্যস্ত সময় কাটাবেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের সঙ্গে নির্ধারিত সেদিনের শীর্ষ বৈঠকে জাপানের পক্ষ থেকে নতুন যে থোক সহায়তা প্রদানের ঘোষণা আসার কথা, এককালীন হিসাবে সেটা এযাবৎকালের সর্ববৃহৎ হতে পারে বলে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট মহল প্রত্যাশা করছে।

অর্থনৈতিক দিক থেকে বড় ধরনের প্রাপ্তি বাংলাদেশ প্রত্যাশা করলেও রাজনৈতিক কিছু বিষয়ে অচলায়তন ভাঙা প্রধানমন্ত্রীর সফরে কতটা সম্ভব হবে, সেই প্রশ্ন অবশ্য থেকে যাচ্ছে। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে জাপানের করণীয় হচ্ছে সে রকম একটি দিক। জাপান শুরু থেকেই রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেওয়ায় মিয়ানমারের ওপর চাপ বৃদ্ধির অনুরোধ এড়িয়ে যাওয়াকে যুক্তিসংগত হিসেবে দেখিয়ে আসছে। টোকিও মনে করে, অবস্থান শক্ত করে নেওয়ার জন্য মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক নেতৃত্বকে আরও বেশি সুযোগ দেওয়া দরকার এবং দেশটির ওপর চাপ প্রয়োগ করা হলে এর ফলাফল শেষ পর্যন্ত ভালো নাও হতে পারে। বাংলাদেশের পক্ষে শরণার্থীর বোঝা সামাল দেওয়া যে ক্রমে বড় এক সমস্যা হয়ে উঠছে, তা বুঝে উঠতে জাপান নারাজ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন সফরে রোহিঙ্গা সমস্যা শীর্ষ বৈঠকে উত্থাপিত হওয়ার কথা। বাংলাদেশ সেখানে বন্ধুপ্রতিম দেশটির প্রতি সমস্যার গভীরতা অনুধাবনে আরও বেশি সচেষ্ট হওয়ার আহ্বান জানাতে পারে।

বাংলাদেশের জন্য আরেকটি বিব্রতকর দিক হচ্ছে তিন বছরের বেশি সময় ধরে ঝুলে থাকা জাপানের আরোপিত ভ্রমণ সতর্কতা। জাপান এই সতর্কতার মাত্রা বৃদ্ধি করেছিল ২০১৫ সালে দেশের উত্তরাঞ্চলে এক জাপানি নাগরিক নিহত হওয়ার পর থেকে। ২০১৬ সালের হোলি আর্টিজান ঘটনার পর এই নিষেধাজ্ঞা অনেকটা যেন স্থায়ীভাবে বাংলাদেশের ওপর বসে গেছে। ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশে যাওয়ার বিষয়ে জাপানি নাগরিকদের নিরুৎসাহিত করে এবং বাংলাদেশে জাপানি বিনিয়োগে এর প্রভাবও এড়িয়ে যাওয়ার মতো নয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশে জাপানি বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেলেও ধারণা করা যায়, ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা শিথিল হয়ে এলে বিনিয়োগের গতি আরও বাড়বে। ফলে, সন্ত্রাসবাদ দমনে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অগ্রগতির আলোকে জাপানের কাছে আরও জোরালোভাবে এই দাবি বাংলাদেশ এখন জানাতে পারে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর জাপানি প্রতিপক্ষের সামনে বিষয়টি উত্থাপন করবেন বলে অনেকেই মনে করছেন।

হোলি আর্টিজান ঘটনার পর বাংলাদেশ সম্পর্কে জাপানের জনগণের ধারণা হঠাৎ করেই নেতিবাচক পথে মোড় নিলেও তিন বছর ধরে বাংলাদেশের নিরলস প্রচেষ্টায় এখন তা অনেকাংশে দূর হয়েছে। ফলে, আশা করা যায়, প্রধানমন্ত্রীর সফর সেই নেতিবাচক অবস্থান থেকে উত্তরণে আরও বেশি অবদান রাখতে সক্ষম হবে।

জাপান সফরের দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিক্কেই শিম্বুনের ব্যবস্থাপনায় আয়োজিত ‘এশিয়ার ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক ফোরামে যোগ দেবেন। বিশ্বজুড়ে চলতে থাকা নানা রকম পরিবর্তনের মুখে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার পাশাপাশি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করে নিতে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলের দেশগুলোর দায়িত্ব ও করণীয় বিষয়াবলির ওপর ফোরামে আলোকপাত করা হয়। ১৯৯৫ সাল থেকে নিক্কেই নিয়মিতভাবে এই বার্ষিক সমাবেশের আয়োজন করে আসছে। এবারের ২৫তম সমাবেশে অতিথি বক্তা হিসেবে থাকছেন ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতার্তে, মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন সেন ও লাওসের সরকারপ্রধান। এ ছাড়া সিঙ্গাপুর ও ভিয়েতনামের উপপ্রধানমন্ত্রী এবং মঙ্গোলিয়ার পার্লামেন্টের স্পিকারও ফোরামে যোগ দেবেন। ফোরামের উদ্বোধনী দিনে মাহাথির মোহাম্মদের পর মূল বক্তব্য উপস্থাপন করবেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এ ছাড়া বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জাপানে অবস্থানকালে প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন।