বিতরণব্যবস্থায় এখনো বড় ঘাটতি

দেশে গত এক দশকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা বেড়েছে প্রায় চার গুণ। কিন্তু এই বিদ্যুৎ নিরবচ্ছিন্নভাবে সরবরাহ করার জন্য বিতরণব্যবস্থার আধুনিকায়ন সেভাবে হয়নি। ফলে সক্ষমতা থাকার পরও প্রায় ৮ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। এর কারণ ওই বিদ্যুৎ উৎপাদন করলেও তা বিতরণ করার মতো অবকাঠামো দেশে এখনো নেই।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র জানায়, এখন ১৮ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। তবে গড়ে প্রতিদিন উৎপাদিত হয় ১০ হাজার মেগাওয়াট। বিতরণব্যবস্থা উন্নত না হওয়ায় বাকি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না।

এ বিষয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব আহমদ কায়কাউস মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ–সংযোগ দেওয়ার ব্যাপারে জোর দিয়েছি। এ কারণে নতুন গ্রাহক অনেক বেড়েছে। একই সঙ্গে পুরোনো গ্রাহকের লোড (বিদ্যুৎ ব্যবহার) বেড়েছে। কিন্তু সে তুলনায় বিতরণব্যবস্থার আধুনিকায়ন হয়নি।’

২১ মে রাত নয়টায় দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছে—১২ হাজার ৫৩৯ মেগাওয়াট। অথচ সেদিনও দেশের বহু স্থানে বিদ্যুৎ ছিল না। ২০০৯ সালে বিদ্যুতের স্থাপিত ক্ষমতা ছিল ৫ হাজার মেগাওয়াট। গত এক দশকে এটি বেড়ে ১৮ হাজার মেগাওয়াটের বেশি উন্নীত হয়েছে। উৎপাদনের পাশাপাশি বিদ্যুৎ সঞ্চালন–ব্যবস্থারও উন্নতি হয়েছে। তবে ঘাটতি থেকে গেছে বিতরণব্যবস্থায়।

বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র জানায়, বিদ্যুৎ সঞ্চালনের দায়িত্বে থাকা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) ৯৫টি গ্রিড বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র ছিল ২০০৮ সালে। গত ১০ বছরে পিজিসিবির উপকেন্দ্র ১৫৮টি হয়েছে। এ ছাড়া আধুনিকায়নের মাধ্যমে পিজিসিবি সঞ্চালন–ব্যবস্থার ক্ষমতাও বাড়িয়েছে।

>বিতরণব্যবস্থার ঘাটতির কারণে ক্ষমতার সবটুকু বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে না সরকার।

পিজিসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আল বেরুনী প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিদ্যুৎ উৎপাদন করার পর তা বিতরণ কোম্পানির কাছে পৌঁছে দেওয়ার সক্ষমতা আমরা অর্জন করেছি।’

দেশে বিদ্যুৎ বিতরণের কাজটি করে চারটি কোম্পানি ও দুটি সংস্থা। এদের গ্রাহক ৩ কোটি ৫০ লাখ। বিতরণের কাজটি করে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি), ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ওজোপাডিকো), নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড (নেসকো), পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি), ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি) ও ঢাকা ইলেকট্রিসিটি পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (ডেসকো)। এর মধ্যে ২ কোটি ৬০ লাখ গ্রাহক হলো আরইবির। আর এই আরইবির অঞ্চলেই রয়েছে ভোল্টেজ সমস্যা।

এ বিষয়ে আরইবির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) মঈন উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আরইবি সারা দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা। গত ১১ মে ৬ হাজার ৭৫৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমরা নিয়েছি বিতরণের জন্য। এরপরও কোথাও কোথাও বিদ্যুৎ ছিল না। কারণ, বিতরণ লাইন বেশ কিছু জায়গাতে ওভার লোড (বিদ্যুৎ বিতরণ ক্ষমতার বেশি গ্রাহক) রয়েছে।’

সারা দেশের তুলনায় ঢাকায় বিদ্যুৎ বিতরণ অবস্থা খানিকটা ভালো। ডিপিডিসির বিতরণব্যবস্থায় কোনো সংকট নেই বলে জানান প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকাশ দেওয়ান। তাঁর দাবি, ডিপিডিসি এলাকায় কোনো লোডশেডিং নেই।

তবে ডিপিডিসির আওতাধীন যাত্রাবাড়ী, বনশ্রী, মতিঝিলসহ কয়েকটি এলাকায় প্রায়ই লোডশেডিং হয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। যদিও ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ অভিযোগ স্বীকার করতে চাননি।

তবে ঢাকার আরেক বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা ডেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. শহীদ সরওয়ার বলেছেন, বসুন্ধরা ও টঙ্গী এলাকাতে বিতরণ উপকেন্দ্রে কিছু ত্রুটি থাকার কারণে বিদ্যুৎ সরবরাহ সমস্যা হচ্ছে। এটি দ্রুত কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছেন তাঁরা।

বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, এ বছরই আরও ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যুক্ত হবে জাতীয় গ্রিডে। আগামী বছর হবে আরও ১৩২০ মেগাওয়াট। বিতরণব্যবস্থার উন্নতি না হলে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বাড়লেও এর সুফল পাওয়া যাবে না।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ম তামিম প্রথম আলোকে বলেন, সরকার বিপুল আকারে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা যখন করেছিল, তখন কিন্তু বিদ্যুৎ বিতরণের পরিকল্পনা একইভাবে করেনি। ফলে ৭ থেকে ৮ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বসে আছে। এতে আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। যদি বিতরণব্যবস্থার উন্নতিই না করা যায়, তাহলে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা না বাড়িয়ে বন্ধ করে দেওয়া উচিত।