ওসিই ছাড়েন নুসরাতের ভিডিও

সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন। ফাইল ছবি
সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন। ফাইল ছবি

ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান কীভাবে অধ্যক্ষের হাতে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছিলেন, এর বিবরণ নিজের মুঠোফোনে রেকর্ড করে প্রচার করেছিলেন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোয়াজ্জেম হোসেন। বক্তব্য ধারণ করার সময় বিপর্যস্ত নুসরাতকে তিনি বারবার বিব্রতকর প্রশ্ন করেছিলেন।

পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) তদন্তে এমন তথ্যই বেরিয়ে এসেছে। আদালতের নির্দেশে করা প্রতিবেদনটি পিবিআই গতকাল রোববার ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালে পাঠিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, মোয়াজ্জেম হোসেন ওসি হিসেবে রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থেকেও নিয়মবহির্ভূতভাবে নুসরাতের বক্তব্যের ভিডিও ধারণ ও প্রচার করে দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিয়েছেন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের তিনটি ধারায় (২৬, ২৯ ও ৩১) ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে অপরাধের প্রমাণ পেয়েছে পিবিআই।

পিবিআইয়ের প্রধান পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) বনজ কুমার মজুমদার গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ওসি মোয়াজ্জেম থানায় নুসরাতের ভিডিও ধারণের কথা স্বীকার করেছেন। তবে তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়াননি বলে দাবি করেন।

সুশৃঙ্খল বাহিনীর সদস্য হয়েও নিয়মবহির্ভূতভাবে শ্লীলতাহানির ঘটনার বক্তব্যের ভিডিও ধারণ ও প্রচার করে অপেশাদারত্বের পরিচয় দিয়েছেন তিনি। এতে পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

যোগাযোগ করা হলে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নুরুল হুদা প্রথম আলোকে বলেন, এটা গুরুতর ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যেহেতু অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া গেছে, এখন আদালত সিদ্ধান্ত নেবেন তাঁকে গ্রেপ্তার করা হবে কি না।

গত ৬ এপ্রিল সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। শরীরের ৮০ শতাংশ পোড়া নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে পাঁচ দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর মারা যান তিনি। মৃত্যুর আগে তাঁকে ছাদে ডেকে নিয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার একটি বর্ণনা দিয়ে যান নুসরাত। গায়ে আগুন দেওয়ার আগে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ এস এম সিরাজ উদদৌলার বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগে নুসরাতের মায়ের করা মামলা তুলে নেওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হয়েছিল।

নুসরাত হত্যার ঘটনা তদন্তে স্থানীয় পুলিশের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ উঠলে পুলিশ সদর দপ্তর ঘটনাটি তদন্ত করে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের সুপারিশ অনুযায়ী ফেনীর পুলিশ সুপার (এসপি) জাহাঙ্গীর আলমকে ১২ মে প্রত্যাহার করা হয়। এর আগে একই তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের সুপারিশ অনুযায়ী ফেনীর সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনকে সাময়িক বরখাস্ত করে রংপুর রেঞ্জ ডিআইজি কার্যালয়ে সংযুক্ত করা হয়। এ ছাড়া সুপারিশ অনুযায়ী বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে অভিযুক্ত এসআই (নিরস্ত্র) মো. ইউসুফকে খুলনা রেঞ্জ ডিআইজি কার্যালয় এবং এসআই (নিরস্ত্র) মো. ইকবাল আহাম্মদকে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায় সংযুক্ত করা হয়। ফেনীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) পি কে এম এনামুল করিমের বিরুদ্ধেও দায়িত্বে অবহেলা ও গাফিলতির সুস্পষ্ট প্রমাণ মিলেছে বলে পুলিশের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। আইনবহির্ভূতভাবে ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহানকে জেরা করে এর ভিডিও প্রচারের অভিযোগে ১৫ এপ্রিল সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সৈয়দ সায়েদুল হক বাদী হয়ে ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালে মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে মামলা নেওয়ার আবেদন করেন। আদালত ৩০ এপ্রিলের মধ্যে এই মামলার তদন্ত করে পিবিআইকে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দেন।

পিবিআই ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ১৪ জনের সাক্ষ্য নিয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে। সংস্থাটি ওসি মোয়াজ্জেমের ব্যবহৃত মুঠোফোন জব্দ করে। ২৩ এপ্রিল পিবিআই সদর দপ্তরে তাঁকে ডেকে এনে জেরা করা হয়।

পিবিআইয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়, সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন গত ২৭ মার্চ বেলা ১টা ১৮ মিনিটে তাঁর ব্যবহৃত মুঠোফোন দিয়ে থানায় আসা ভুক্তভোগী নুসরাত জাহানের বক্তব্য ধারণ করেন। এতে নির্যাতনের শিকার মেয়েটির ব্যক্তিগত পরিচিতির তথ্য প্রকাশ পায়। এই অপরাধে মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮–এর ২৬ ধারায় অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে। মোয়াজ্জেম এই ভিডিও ৮ এপ্রিল শেয়ারইট অ্যাপের মাধ্যমে ‘সজল’ নামের একটি ডিভাইসে পাঠান। এতে তাঁর বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৯ ধারার অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ভিডিওটি ভাইরাল হওয়ায় সামাজিক অস্থিরতার সৃষ্টি ও আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটার উপক্রম হয়। এর মাধ্যমে তিনি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩১ ধারায় অপরাধ করেছেন।

>

পিবিআইয়ের তদন্তে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের তিনটি ধারায় অপরাধের প্রমাণ
জিজ্ঞাসাবাদের সময় ওসি সহনশীল আচরণ করেননি
ভিডিও ভাইরাল হওয়ায় সামাজিক অস্থিরতার সৃষ্টি হয়

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভিডিওর কথোপকথন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ওসি তাঁর অফিসকক্ষে নুসরাতকে বেশ কয়েকজন পুরুষের সামনে যৌন নিপীড়নের বক্তব্য শোনেন। ওসি নুসরাতকে বারবার ‘অধ্যক্ষের কক্ষে তুমি নিজে গিয়েছিলে, না তোমাকে কেউ ডেকে নিয়ে গিয়েছিল?’ এই প্রশ্নসহ বিভিন্ন বিব্রতকর প্রশ্ন করেন। ওসি যৌন হয়রানির ঘটনার বর্ণনা শোনার পরও বলেন, ‘এটা কোনো ব্যাপার না। শান্ত হও, এমন কিছু হয়নি যে তোমার এখনই কাঁদতে হবে।’ এ সময় আরও কিছু প্রশ্ন করা হয়, যা ছাপার অযোগ্য।

নুসরাত জাহান
নুসরাত জাহান

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, যেহেতু নারী ও শিশুরা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে বিপর্যস্ত অবস্থায় থানায় আসে, তাই নারী ও শিশুদের জিজ্ঞাসাবাদের সময় পুলিশ সদস্যদের সহনশীল হওয়া প্রয়োজন। নুসরাত অল্প বয়সের মেয়ে ও ছাত্রী। এ বিষয়গুলো বিবেচনা করে জিজ্ঞাসাবাদের সময় মোয়াজ্জেম হোসেনের আরও কৌশলী হয়ে নারী ও শিশুবান্ধব উপায়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার প্রয়োজন ছিল।

পিবিআইয়ের তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে যোগাযোগ করলে গতকাল ওসি মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমার বক্তব্য পিবিআইকে দিয়েছি।’

তবে গত ১৪ এপ্রিল সোনাগাজী থানায় করা একটি সাধারণ ডায়েরিতে (জিডি) তিনি দাবি করেছিলেন, ঘটনাটি স্পর্শকাতর এবং একজন মাদ্রাসা অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগে তাঁকে আটক বা গ্রেপ্তার করলে আলেম সমাজ আন্দোলন করতে পারে, এই সন্দেহ থেকে নুসরাতের জবানবন্দির ভিডিও তিনি ধারণ করেছিলেন। ভিডিওটি সজল নামক ডিভাইসে পাঠানোর বিষয়ে তিনি বলেছিলেন, সজল নামের এক ব্যক্তি তাঁর অনুমতি ছাড়া ভিডিওটি তাঁর মুঠোফোনে স্থানান্তর করেন।

ওসির এই জিডির পর ২ মে ফেনী মডেল থানায় পাল্টা জিডি করেন মো. আতিয়ার হাওলাদার সজল নামে বেসরকারি টেলিভিশনের একজন স্থানীয় প্রতিনিধি। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, ওসি মোয়াজ্জেম স্বেচ্ছায়, স্বজ্ঞানে, অতি–উৎসাহী হয়ে নিজেই ভিডিওটি সম্প্রচারের জন্য দিয়েছিলেন।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আশা করি বিচারের মাধ্যমে দোষী ব্যক্তির উপযুক্ত শাস্তি হবে। তদন্ত প্রতিবেদনে ভুলভ্রান্তির কারণে অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তা যদি দোষী প্রমাণিত না হন, তাহলে এ প্রতিবেদনের যথার্থতা নিয়ে জনগণের মধ্যে প্রশ্ন থেকে যাবে।’