এফ আর টাওয়ার নির্মাণে কোনো নীতিমালা মানা হয়নি: দুদক

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

বনানীর এফ আর টাওয়ারের ১৫ তলা থেকে ২৩ তলা অনিয়মের মাধ্যমেই তৈরি করা হয়েছে। শুরুতে ১৫ তলা ভবনের নকশা অনুমোদনেও মানা হয়নি নীতিমালা। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

দুদকের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ১৮ থেকে ২৩ তলা নির্মাণের কোনো তথ্যই নেই রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউকের) কাছে। জমির মালিক ও ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি প্রশাসনের নাকের ডগায় নিজেদের সিদ্ধান্তে নির্মাণ করেছে বাকি ৫ তলা। এ ছাড়া ফায়ার সার্ভিস, পরিবেশ অধিদপ্তর ও সিভিল এভিয়েশনের ছাড়পত্রও নেওয়া হয়নি।

এসব অনিয়মের সঙ্গে ভবনমালিক, ডেভেলপার কোম্পানি রূপায়ণ ও রাজউকের নানা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতা পেয়েছে দুদক। এফ আর টাওয়ার নির্মাণে অনিয়ম–দুর্নীতি খতিয়ে দেখতে দুদকের অনুসন্ধান দলের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। ইতিমধ্যে দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা হয়েছে বলে সংস্থাটির একাধিক সূত্র প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছে।

সূত্র জানায়, অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত অন্তত ৩০ জনের বিরুদ্ধে মামলা হতে পারে। এঁদের মধ্যে রাজউকের সাবেক একজন চেয়ারম্যান, কয়েকজন অথরাইজড অফিসার, ইমারত পরিদর্শক, রূপায়ণ গ্রুপের পরিচালনা পরিষদের শীর্ষ ব্যক্তিরা রয়েছেন।

অনুসন্ধান–সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা এবং একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা উদ্ধৃত না হওয়ার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, এফ আর টাওয়ারের ৮ তলা ভবন পর্যন্ত নকশা অনুমোদন ও নির্মাণ বৈধভাবে হয়েছে। কিন্তু ১৫ তলা পর্যন্ত নির্মাণের জন্য অনুমোদনে কোনো নিয়মকানুন মানা হয়নি। তাঁরা জানান, শুরুতে ১৯৯৬ সালের নভেম্বরে সিভিল এভিয়েশনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ছাড়পত্র না পাওয়ার কারণে নকশা অনুমোদন না দিয়ে এফ আর টাওয়ার কর্তৃপক্ষকে ফিরিয়ে দেয় রাজউক। পরে অদৃশ্য কারণে একই বছরের ডিসেম্বরে ১৮ তলার অনুমোদন দেয় রাজউক। অনুমোদন ফাইলে নোট হিসেবে লেখা ছিল, ‘যেহেতু আশপাশে ১৮ তলা ভবন আছে তাই নকশা অনুমোদন দেওয়া যায়।’

অনুসন্ধান করে দুদক দেখেছে, ওই সব কাগজপত্রই ছিল ভুয়া। অনুমোদনের আগে এস্টেট শাখার অনুমোদনও নেওয়া হয়নি।

অনুসন্ধান–সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনুসন্ধানের কাজ শেষ হয়ে গেছে। অপরাধীদেরও প্রাথমিকভাবে শনাক্ত করা হয়েছে। শিগগিরই কমিশনে অনুসন্ধান প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে। কমিশনের অনুমোদন পাওয়া সাপেক্ষে মামলা করা হবে।

এ বিষয়ে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘দোষী ব্যক্তিদের কোনোভাবেই ছাড় দেব না। আমাদের অনুসন্ধান দল কাজ করছে। অনিয়মের সঙ্গে কারা জড়িত, সেটা পরিষ্কার হয়ে গেছে। আমাদের কর্মকর্তারা কাজ করছেন। শিগগিরই আপনারা বিস্তারিত তথ্য জানতে পারবেন।’

চলতি বছরের ২৮ মার্চ বনানীর এফ আর টাওয়ারে আগুন লাগে। এর পরপরই ভবনটির নির্মাণে অনিয়ম ও দুর্নীতির তথ্য উঠে আসে। এরই ধারাবাহিকতায় গত ৩ এপ্রিল এ বিষয়ে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। এর পরদিনই নয় সংস্থায় তথ্য চেয়ে চিঠি দেন অনুসন্ধান কর্মকর্তা ও দুদকের উপপরিচালক আবু বকর সিদ্দিক। যেসব সংস্থায় চিঠি দেওয়া হয়, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ, পরিবেশ অধিদপ্তর, ঢাকা মহানগর পুলিশ, ঢাকা সিটি করপোরেশন, ঢাকা যানবাহন সমন্বয় বোর্ড ও ঢাকা ওয়াসা।

আগুন লাগার ঘটনায় করা মামলায় তিনজনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করা হয়। তিন আসামি হলেন এফ আর টাওয়ারের জমির মালিক এস এম এইচ আই ফারুক, ভবন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান রূপায়ণ গ্রুপের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী খান মুকুল এবং এফ আর টাওয়ারের বর্ধিত অংশের মালিক বিএনপি নেতা তাসভির উল ইসলাম। এঁদের মধ্যে এস এম এইচ আই ফারুক ও তাসভির উল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। মামলাটির তদন্ত করছে গোয়েন্দা পুলিশ।

এফ আর টাওয়ারে অনিয়মের ঘটনায় গঠিত গণপূর্ত মন্ত্রণায়ের তদন্ত কমিটি অর্ধশতাধিক ব্যক্তিকে দায়ী করেছে। ২২ মে গণপূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম এক সংবাদ সম্মেলনে তদন্ত কমিটির ওই প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। ওই দিন তিনি বলেন, এফ আর টাওয়ারের নকশা অনুমোদনে বিধি লঙ্ঘন এবং নির্মাণের ক্ষেত্রে ত্রুটি-বিচ্যুতি ছিল। শুধু তা–ই নয়, অবৈধভাবে নির্মাণ করা হয়েছে ভবনটির ১৯ থেকে ২৩ তলা। আর এসব অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ছিলেন রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান মো. হ‌ুমায়ূন খাদেমসহ অর্ধশতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী। মন্ত্রী বলেন, অবৈধভাবে নির্মিত ১৯ থেকে ২৩ তলা পর্যন্ত ভেঙে ফেলা হবে। এ জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আলাদা মামলা করা হবে। আর ১৬ থেকে ১৮ তলা পর্যন্ত অনুমোদনের ক্ষেত্রে আইনি ত্রুটি থাকায় সংশ্লিষ্টদের শাস্তির আওতায় আনা হবে।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়েছে। পাশাপাশি ওই জমির মালিক সৈয়দ মো. হোসাইন ইমাম ফারুক এবং এফ আর টাওয়ার ওনার্স সোসাইটিও অগ্নিদুর্ঘটনার দায় এড়াতে পারে না।

গণপূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেন, যাঁদের নাম এ প্রতিবেদনে এসেছে, তাঁদের বিরুদ্ধে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এফ আর টাওয়ারের অবৈধ কাজের সঙ্গে জড়িত রাজউকের কর্মকর্তাসহ যাঁরা জড়িত, তাঁদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রযোজ্য ক্ষেত্রে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বলা হবে। যাঁরা অবসরে গেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে প্রযোজ্য প্রক্রিয়ায় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যাঁরা এখনো কর্মরত, তাঁদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে পরিপূর্ণভাবে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

মন্ত্রী বলেন, ১৯৯০ সালে এফ আর টাওয়ারের মাল্টি পারপাস কমার্শিয়াল ১৫ তলা ভবনের নকশা অনুমোদনপ্রক্রিয়া এবং অনুমোদন যথাযথ ছিল। কিন্তু ১৯৯৬ সালে ওই ভবনের ১৯ তলা আবাসিক কাম বাণিজ্যিক ভবনের নকশা অনুমোদনের ক্ষেত্রে ইমারত বিধিমালা মানা হয়নি। কেননা, ‘১৯৯৬ সালের ইমারত বিধিমালা জারি হওয়ার পরেও বনানীর এফ আর টাওয়ারের নকশা অনুমোদন করা হয় ১৯৮৪ সালের পুরোনো বিধিমালার আলোকে। এ ক্ষেত্রে রাজউকের তৎকালীন চেয়ারম্যান হ‌ুমায়ূন খাদেমসহ সংশ্লিষ্টরা তাঁদের দায় এড়াতে পারেন না।’

তদন্ত প্রতিবেদনে ভবন নির্মাণের অনিয়ম ও ত্রুটিতে যেসব ব্যক্তিকে দায়ী করা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান হ‌ুমায়ূন খাদেম ছাড়াও রাজউকের সাবেক সদস্য ডি এম ব্যাপারী, রাজউকের সাবেক নগর–পরিকল্পনাবিদ জাকির হোসেন, সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মো. সাইদুর রহমান, সাবেক অথরাইজড অফিসার-২ সৈয়দ মকবুল আহমেদ, সাবেক সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ উল্লাহ এবং জমির মূল মালিক এস এম এইচ আই ফারুক, সাবেক অথরাইজড অফিসার এ টি এম কামরুজ্জামান, সাবেক অথরাইজড অফিসার নাজমুল হুদা, সাবেক সহকারী অথরাইজড অফিসার মো. বদরুজ্জামান মিয়া, সাবেক সহকারী অথরাইজড অফিসার বশির উদ্দিন খান, ইমারত পরিদর্শক ইমরুল কবির, ইমারত পরিদর্শক মো. শওকত আলী, উচ্চমান সহকারী মুহাম্মদ আবদুর রহমান, উচ্চমান সহকারী (সাময়িক বরখাস্ত) মো. সফিউল্লাহ, নিম্নমান সহকারী মো. মজিবুর রহমান (সাময়িক বরখাস্ত), সাবেক তত্ত্বাবধায়ক জাহানারা বেগম, বিষয় পরিদর্শক মো. মেহেদুজ্জামান, সহকারী পরিচালক শাহ মো. সদরুল আলম, উপপরিচালক মুহাম্মদ শওকত আলী (প্রেষণ), পরিচালক শামসুল আলম (প্রেষণ), সদস্য (এস্টেট) রাজউল করিম তরফদার, তত্ত্বাবধায়ক মোফাজ্জল হোসেন, তৎকালীন সহকারী পরিচালক মো. এমদাদ আলী বিশ্বাস (মৃত), পরিচালক আবদুল্লাহ আল বাকী, সদস্য আ ই ম গোলাম কিবরিয়া, অফিস সহকারী মো. এনামুল হক, তৎকালীন ইমারত পরিদর্শক নজরুল ইসলাম প্রমুখ।