সোহাগ মিয়া ও সাব্বির মিয়া পিতৃহারা দরিদ্র পরিবারের সন্তান। কিন্তু এই দারিদ্র্য তাদের পড়াশোনায় বাধা হতে পারেনি। তারা দুজনেই এবার ঝিনাইদহ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগরের দুটি বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে জিপিএ-৫ পেয়েছে। তাদের স্বপ্ন অনেক বড়। তারা দুজনই চিকিৎসক হয়ে মানুষের সেবা করতে চায়।
এই দুজনের মতোই সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জের রাকিব ও নড়াইলের লোহাগড়ার মাজেদা নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যে পড়াশোনা করে এসএসসিতে ভালো ফল করেছে।
রাজমিস্ত্রির সহযোগীর চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন
সোহাগ মিয়ার (১৬) বাড়ি ঝিনাইদহ সদর উপজেলার ধোপাবিলা গ্রামে। ধোপাবিলা মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান শাখায় জিপিএ-৫ পেয়েছে সে। তার রাজমিস্ত্রি বাবা জাহিদুল ইসলাম ২০১২ সালে অর্থের অভাবে একপ্রকার চিকিৎসা ছাড়াই মারা যান।
মৃত্যুর পর দুই সন্তানকে নিয়ে বিপদে পড়েন রত্না বেগম।এ অবস্থায়প্রতিবেশী রংমিস্ত্রি জহির রায়হানের সহযোগিতায় পড়ালেখা করেছে সোহাগ। রত্না বেগম বলেন, চার শতক জমির ওপর মাটির ঘর ও দুটি সন্তান ছাড়া তাঁর আর কিছুই নেই। কীভাবে ছেলের পড়ালেখা হবে, তা ভেবে পাচ্ছেন না তিনি।
সোহাগ জানায়, তার স্বপ্ন চিকিৎসক হওয়ার ও গরিব মানুষের সেবা করার। লেখাপড়ার খরচ কোথা থেকে আসবে, তা নিয়ে সে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়নি। এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পর পুরোদমে রাজমিস্ত্রির সহযোগীর কাজ করে টাকা জমিয়েছে।
কুড়ানো কাগজে লেখত সাব্বির
সাব্বিরের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার সিঙ্গারবিল ইউনিয়নের সিঙ্গারবিল গ্রামে। সে বিজয়নগরের মেরাশানী পলিটেকনিক একাডেমি থেকে এবার এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে।
জন্মের তিন বছরের মাথায় বাবাকে হারায় সাব্বির মিয়া। পরিবারে দারিদ্র্য শুরু তখনই। তার মা জাহানারা বেগম গাজীপুরের টঙ্গীর একটি পোশাক কারখানায় পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে কাজ করেন।
তিন ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোটসাব্বির জানায়, সে টঙ্গীর একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে। খরচ বেশি হওয়ায়বিজয়নগরের সিঙ্গারবিল গ্রামে খালার বাড়িতে চলে আসে। সে অন্যদের ফেলে দেওয়া অব্যবহৃত খাতার পাতা কুড়িয়ে ও রাস্তায় পড়ে থাকা পোস্টার কুড়িয়ে খাতা বানিয়ে লিখেছে। সাব্বির বলে, ‘আমি লেখাপড়া করে চিকিৎসক হতে চাই। আমার মতো আর কারও বাবা যেন চিকিৎসার অভাবে মারা না যান।’
পিছিয়ে পড়া শিশুদের জন্য কাজ করবে রাকিব
আগে পড়াশোনার ফাঁকে তাঁতের কাজ করত রাকিব। এসএসসি পরীক্ষার পর সে নিয়মিত তাঁতশ্রমিক। এভাবে লড়াই-সংগ্রাম করেই জিপিএ-৫ পেয়েছে হতদরিদ্র ঘরের এই সন্তান।
রাকিবের বাড়ি সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার পাঙ্গাসী ইউনিয়নের পাঙ্গাসী গ্রামে। সে পাঙ্গাসী লায়লা-মিজান স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এবারের এসএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ থেকে অংশ নেয়। সম্পদ বলতে আছে বসতবাড়ির ৫-৬ শতক জমি। বাবা বাচ্চু সরকার তাঁতের ব্যবসা করতেন। তাঁতের ব্যবসার জন্য সিরাজগঞ্জ শহরের একজনের কাছ থেকে কিছু টাকা ঋণ নেন। কিন্তু এর ফাঁদে পড়ে চেক জালিয়াতির মামলার আসামি হয়ে তিনি চার বছর ধরে ‘নিখোঁজ’। মা রহিমা বেগম অন্যের বাড়িতে তাঁতের সুতা কাটেন।
মা রহিমা বেগম বলেন, ছেলেটা খুবই মেধাবী। জেএসসি ও প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষাতেও জিপিএ-৫ পেয়েছিল। চার ছেলেমেয়ের লেখাপড়া আর সংসারের খরচ টানতে গিয়ে হিমশিম অবস্থা তাঁর।
রাকিব বলে, উচ্চতর শিক্ষা অর্জন করতে চায় সে। এরপর কর্মজীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের কল্যাণে কাজ করার ইচ্ছা আছে তার।
সাংবাদিক হতে চায় ভিটেহারা মাজেদা
মাজেদার পৈতৃক ভিটা ছিল নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার কোটাকোল ইউনিয়নের ঘাঘা গ্রামে। মধুমতীর ভাঙনে ভিটেছাড়া হওয়ার পর থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত পরিবারটি ছিল যশোরে। তিন বছর ধরে তারা বসবাস করছে লোহাগড়া উপজেলা সদরের গোপীনাথপুরে। সেখানে ৫০০ টাকা ভাড়ায় টিনের একটি ঝুপড়িঘর ভাড়ায় নিয়েছেন রিকশাভ্যানচালক বাবা মোক্তার। মেয়ে মাজেদা লোহাগড়া সরকারি পাইলট উচ্চবিদ্যালয় থেকে এবার মানবিক বিভাগে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়।
দুই বোনের মধ্যে বড় মাজেদা। বাবার ভ্যান চালানোর আয় দিয়ে চলে তাদের চার সদস্যের সংসার। বাবা মোক্তার হোসেন এক মাস আগে ভ্যান চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনায় আহত হন। এখন ঘরে বসে দিন কাটছে তাঁর। মাজেদার বাবা-মা দুজনের ইচ্ছা মেয়ে দুটিকে পড়াশোনা শিখিয়ে মানুষ করবেন। সে কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেললেন বাবা মোক্তার হোসেন। বললেন, ‘দুমুঠো ভাত তুলে দিতে পারি না সন্তান দুটির মুখে। এ অবস্থায় তারা পড়াশোনা চালাচ্ছে। কীভাবে সামলাব?’
টিভির খবর দেখে মাজেদার সাংবাদিক হওয়ার ইচ্ছা জাগে। এখনো সেই ইচ্ছা মনেপ্রাণে পুষে রেখেছে। কারণ সাংবাদিক হলে সমাজের জন্য কাজ করা যায়।
[প্রতিবেদনের তথ্য দিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, ঝিনাইদহ; প্রতিনিধি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, লোহাগড়া, নড়াইল ও রায়গঞ্জ, সিরাজগঞ্জ]