সোনাগাজীর সাবেক ওসি মোয়াজ্জেমকে গ্রেপ্তারে পরোয়ানা

সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন। ফাইল ছবি
সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন। ফাইল ছবি

ফেনীর সোনাগাজী থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আদেশ দিয়েছেন আদালত। আজ সোমবার ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোহাম্মাদ আসসামস জগলুল হোসেন এই আদেশ দেন।

সাইবার ট্রাইব্যুনালের সরকারি কৌঁসুলি নজরুল ইসলাম শামীম প্রথম আলোকে বলেন, সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) দেওয়া অভিযোগপত্র আদালত আমলে নিয়েছেন। একই সঙ্গে মামলার আসামি সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির নির্দেশ দিয়েছেন। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা তামিলসংক্রান্ত প্রতিবেদন আগামী ১৭ জুনের মধ্যে জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।

ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান কীভাবে অধ্যক্ষের হাতে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছিলেন, এর বিবরণ নিজের মুঠোফোনে রেকর্ড করে প্রচার করেছিলেন থানার ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন। বক্তব্য ধারণ করার সময় বিপর্যস্ত নুসরাতকে তিনি বারবার বিব্রতকর প্রশ্ন করেছিলেন। পিবিআইয়ের তদন্তে এমন তথ্যই বেরিয়ে এসেছে। আদালতের নির্দেশে করা প্রতিবেদনটি পিবিআই গতকাল রোববার ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালে পাঠায়। এতে বলা হয়েছে, মোয়াজ্জেম হোসেন ওসি হিসেবে রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থেকেও নিয়মবহির্ভূতভাবে নুসরাতের বক্তব্যের ভিডিও ধারণ ও প্রচার করে দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিয়েছেন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের তিনটি ধারায় (২৬,২৯ ও ৩১) ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে অপরাধের প্রমাণ পেয়েছে পিবিআই।

পিবিআইয়ের প্রধান পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) বনজ কুমার মজুমদার গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ওসি মোয়াজ্জেম থানায় নুসরাতের ভিডিও ধারণের কথা স্বীকার করেছেন। তবে তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়াননি বলে দাবি করেন।

সুশৃঙ্খল বাহিনীর সদস্য হয়েও নিয়মবহির্ভূতভাবে শ্লীলতাহানির ঘটনার বক্তব্যের ভিডিও ধারণ ও প্রচার করে অপেশাদারত্বের পরিচয় দিয়েছেন তিনি। এতে পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

গত ৬ এপ্রিল সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। শরীরের ৮০ শতাংশ পোড়া নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে পাঁচ দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর মারা যান তিনি। মৃত্যুর আগে তাঁকে ছাদে ডেকে নিয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার একটি বর্ণনা দিয়ে যান নুসরাত। গায়ে আগুন দেওয়ার আগে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ এস এম সিরাজ উদদৌলার বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগে নুসরাতের মায়ের করা মামলা তুলে নেওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হয়েছিল।

নুসরাত হত্যার ঘটনা তদন্তে স্থানীয় পুলিশের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ উঠলে পুলিশ সদর দপ্তর ঘটনাটি তদন্ত করে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের সুপারিশ অনুযায়ী ফেনীর পুলিশ সুপার (এসপি) জাহাঙ্গীর আলমকে ১২ মে প্রত্যাহার করা হয়। এর আগে একই তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের সুপারিশ অনুযায়ী ফেনীর সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনকে সাময়িক বরখাস্ত করে রংপুর রেঞ্জ ডিআইজি কার্যালয়ে সংযুক্ত করা হয়। এ ছাড়া সুপারিশ অনুযায়ী বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে অভিযুক্ত এসআই (নিরস্ত্র) মো. ইউসুফকে খুলনা রেঞ্জ ডিআইজি কার্যালয় এবং এসআই (নিরস্ত্র) মো. ইকবাল আহাম্মদকে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায় সংযুক্ত করা হয়।

ফেনীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) পি কে এম এনামুল করিমের বিরুদ্ধেও দায়িত্বে অবহেলা ও গাফিলতির সুস্পষ্ট প্রমাণ মিলেছে বলে পুলিশের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। আইনবহির্ভূতভাবে ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহানকে জেরা করে এর ভিডিও প্রচারের অভিযোগে ১৫ এপ্রিল সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সৈয়দ সায়েদুল হক বাদী হয়ে ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালে মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে মামলা নেওয়ার আবেদন করেন। আদালত ৩০ এপ্রিলের মধ্যে এই মামলার তদন্ত করে পিবিআইকে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দেন।

পিবিআই ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ১৪ জনের সাক্ষ্য নিয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে। সংস্থাটি ওসি মোয়াজ্জেমের ব্যবহৃত মুঠোফোন জব্দ করে। ২৩ এপ্রিল পিবিআই সদর দপ্তরে তাঁকে ডেকে এনে জেরা করা হয়।

পিবিআইয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়, সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন গত ২৭ মার্চ বেলা ১টা ১৮ মিনিটে তাঁর ব্যবহৃত মুঠোফোন দিয়ে থানায় আসা ভুক্তভোগী নুসরাত জাহানের বক্তব্য ধারণ করেন। এতে নির্যাতনের শিকার মেয়েটির ব্যক্তিগত পরিচিতির তথ্য প্রকাশ পায়। এই অপরাধে মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮-এর ২৬ ধারায় অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে। মোয়াজ্জেম এই ভিডিও ৮ এপ্রিল শেয়ারইট অ্যাপের মাধ্যমে ‘সজল’ নামের একটি ডিভাইসে পাঠান। এতে তাঁর বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৯ ধারার অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ভিডিওটি ভাইরাল হওয়ায় সামাজিক অস্থিরতার সৃষ্টি ও আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটার উপক্রম হয়। এর মাধ্যমে তিনি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩১ ধারায় অপরাধ করেছেন।

পিবিআইয়ের তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে যোগাযোগ করলে গতকাল ওসি মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমার বক্তব্য পিবিআইকে দিয়েছি।’

তবে গত ১৪ এপ্রিল সোনাগাজী থানায় করা একটি সাধারণ ডায়েরিতে (জিডি) তিনি দাবি করেছিলেন, ঘটনাটি স্পর্শকাতর এবং একজন মাদ্রাসা অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগে তাঁকে আটক বা গ্রেপ্তার করলে আলেম সমাজ আন্দোলন করতে পারে, এই সন্দেহ থেকে নুসরাতের জবানবন্দির ভিডিও তিনি ধারণ করেছিলেন। ভিডিওটি সজল নামক ডিভাইসে পাঠানোর বিষয়ে তিনি বলেছিলেন, সজল নামের এক ব্যক্তি তাঁর অনুমতি ছাড়া ভিডিওটি তাঁর মুঠোফোনে স্থানান্তর করেন।

ওসির এই জিডির পর ২ মে ফেনী মডেল থানায় পাল্টা জিডি করেন মো. আতিয়ার হাওলাদার সজল নামে বেসরকারি টেলিভিশনের একজন স্থানীয় প্রতিনিধি। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, ওসি মোয়াজ্জেম স্বেচ্ছায়, স্বজ্ঞানে, অতি উৎসাহী হয়ে নিজেই ভিডিওটি সম্প্রচারের জন্য দিয়েছিলেন।