নাকফজলি ও রানিপছন্দ আম আসছে জুন মাস

রানিপছন্দ। ছবি: লেখক
রানিপছন্দ। ছবি: লেখক

আম খুবই সুশৃঙ্খল ফল। প্রজাতিভেদে বিভিন্ন আম নির্দিষ্ট সময়ে পরিপক্ব হয় ও শেষ হয়ে যায়। রাসায়নিক মিশিয়েও একে বেশি দিন রাখা যায় না। তাই আম পরিপক্ব হওয়ার সঠিক সময় জেনে আম খাওয়া উচিত। তাহলে রাসায়নিকমুক্ত তাজা আম খাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে।

মে মাসের মাঝামাঝি থেকে শুরু হয়েছে আমের মৌসুম। আম পাওয়া যাবে আগামী পাঁচ মাস। এই পাঁচ মাসের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রজাতির আম পাকবে এবং বাজারে আসবে। জুন মাসের শুরুতে, অর্থাৎ ১ তারিখ থেকে বাজারে পাওয়া যাবে বাংলাদেশে উৎপাদিত অতি উন্নত জাতের সুস্বাদু রানিপছন্দ এবং নাকফজলি আম। চলুন, আম দুটির বিষয়ে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।

নাকফজলি
মুর্শিদাবাদের নবাবদের বিখ্যাত আমবাগানে উদ্ভাবিত অতি উৎকৃষ্ট জাতের আম নাকফজলি। এই মুহূর্তে বৃহত্তর রাজশাহীসহ পার্শ্ববর্তী জয়পুরহাট ও নওগাঁ জেলার বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপকভাবে পরিচিতি পেলেও বাংলাদের অন্যান্য আমভক্ত মানুষের কাছে অপরিচিত রয়ে গেছে দারুণ স্বাদের এই আম। বর্তমানে নওগাঁ জেলার বদলগাছি, ধামইরহাট, সদর, রানীনগর ও মহাদেবপুর উপজেলায় নাকফজলি আমের চাষ হচ্ছে ব্যাপকভাবে। বদলগাছি থানার শ্রীরামপুর, দেউকুড়ী, কোলা, ভান্ডারপুর, দ্বীপগঞ্জ ও দুধকুরি গ্রামে এ আমের অসংখ্য বাগান গড়ে উঠেছে। ভান্ডারপুর গ্রামের প্রখ্যাত জমিদার বিনোদ কুমার লাহিড়ী বহুকাল আগে তীর্থভূমি কাশীতে গিয়েছিলেন। গঙ্গাতীরবর্তী কাশী বা বেনারস ভারতের প্রধান আম উৎপাদন এলাকাগুলোর মধ্যে অন্যতম। এখানেই উদ্ভাবিত হয়েছিল বিশ্ববিখ্যাত আম ল্যাংড়া। জমিদার বিনোদ লাহিড়ী তীর্থকর্ম শেষে কাশী থেকে দেশে ফেরার পথে কয়েকটি নাকফজলি আমের চারা সংগ্রহ করে ভান্ডারপুরে নিজস্ব আমবাগানে রোপণ করেন। এরপর এই আম কলমের চারার মাধ্যমে আশপাশের গ্রামগুলোয় ছড়িয়ে যেতে থাকে। এভাবেই আমটি পরিচিতি পায় ভান্ডারপুর গ্রামের বাইরে। নওগাঁর দুবলহাটি ও বলিহার রাজবাড়ির বাগানেও এ আমের গাছ ছিল বলে জানা যায়।

নাকফজলি আম লম্বায় প্রায় চার ইঞ্চি আর চওড়ায় দেড় ইঞ্চি হয়ে থাকে। এর নিম্নাংশ বাঁকানো। নাক বড় এবং স্পষ্ট বেরিয়ে আসা। আমটির গড় ওজন ৩০০ গ্রাম। আকারে অনেকটা বড় এবং নাক স্পষ্ট, এ কারণে এর নাম হয়েছে নাকফজলি। পরিপক্ব অবস্থায় এর ত্বকের রং কলাপাতা সবুজ। পাকার পর বোঁটার আশপাশে হালকা লাল রঙের পাশাপাশি অনেকটা অংশজুড়ে হলুদ রং ধারণ করে। লাল, হলুদ ও সবুজের মিশ্রণে বিচিত্র একটি বর্ণের সৃষ্টি হয় আমটিতে। ফলটির ত্বক মসৃণ, খোসা পাতলা, শাঁস আঁশবিহীন অত্যন্ত মোলায়েম। স্বাদে–গন্ধে তুলনাহীন। অত্যন্ত রসাল এই আমের মিষ্টতা রানিপছন্দ ও গোপালভোগ আমের সমান। শাঁসের রং কমলাভ।

নাকফজলি আম। ছবি: সৌজন্যে শুভ’স আম।
নাকফজলি আম। ছবি: সৌজন্যে শুভ’স আম।

নাকফজলি আম প্রতিবছর ফলে। একেকটি গাছে ফল আসে প্রচুর পরিমাণে। পরিপক্ব আম সংগ্রহের পর প্রায় ১৫ দিন ঘরে রেখে খাওয়া যায়। গাছটির গড়ন মাঝারি। নাকফজলি আমের উচ্চ গুণের তুলনায় এর প্রচার অনেক কম। এখন অবধি নওগাঁ জেলা ও এর পাশের জয়পুরহাট জেলার কয়েকটি গ্রামে এই জাতটির চাষাবাদ চলছে। ২০০৯ সালে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন বৃক্ষ প্রদর্শনীতে প্রথম এই আমের চারা বিক্রি হতে দেখা গেছে। তবে আমটির বাণিজ্যিক সফলতা দ্রুত বাড়ছে। বাংলাদেশে উৎপাদিত প্রথম শ্রেণির ১৫টি আমের মধ্যে অনায়াসে নাকফজলিকে গণ্য করা যায়।

নাকফজলি মধ্য মৌসুমি জাতের আম। জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের শুরু থেকে অর্থাৎ জুন মাসের ৮ তারিখ থেকে ২৫ তারিখ পর্যন্ত নাকফজলি আমের ভরা মৌসুম। এরপর বাজারে (নওগাঁ এলাকার) এই আম পাওয়া যায় না।

রানিপছন্দ
মুর্শিদাবাদের নবাব ও কাশিম বাজারের রানির পৃষ্ঠপোষকতায় রানিপছন্দ নামের অত্যন্ত সুস্বাদু আমটি জন্ম নিয়েছে বলে জানা যায়। আমটি আশু বা আগাম জাতের। আকারে ছোট ও গোলাকার। ফলটির বোঁটা শক্ত, খোসা পাতলা, আঁশ নেই, ত্বক মসৃণ। পরিপক্ব অবস্থায় হালকা সবুজ এবং পাকলে হলুদ রং ধারণ করে। অত্যন্ত মিষ্টি স্বাদের সুগন্ধযুক্ত আম রানিপছন্দ। আমের খাদ্যাংশের পরিমাণ শতকরা ৬৫ ভাগ। আমটির ওজন ১২৫ থেকে ১৫০ গ্রামের মধ্যে। সুপক্ব রানিপছন্দ খোসা ছাড়িয়ে নিলে শাঁস এমনিতেই আঁটি থেকে বেরিয়ে আসে। এর শাঁসের রং কম লাভ। মিষ্টতার পরিমাণ শতকরা ২২ ভাগ। একেকটি গাছে প্রচুর পরিমাণে আম ধরে। প্রতিবছরই প্রায় গাছে ফল পাওয়া যায়। রানিপছন্দ আম ভারতের উত্তর প্রদেশ এবং পাকিস্তানের পাঞ্জাবে উৎপন্ন বিশ্বখ্যাত ‘আনোয়ার রাতাউল’ নামক আমের মতো দেখতে। গাছ থেকে পরিপক্ব ফল সংগ্রহের পর আট থেকে নয় দিন ঘরে রাখা যায়। ‘গিরাদাগী’ নামের অতি উৎকৃষ্ট জাতের একটি আমের সঙ্গে রানিপছন্দ আমটি অদল-বদল করা যায় সহজেই। খেতেও প্রায় একই স্বাদের। তবে গিরাদাগী পাকার পর আকর্ষণীয় হলুদ রং ধারণ করে কিন্তু রানিপছন্দ হলুদ রং ধারণ করলেও সেটি আকর্ষণীয় বর্ণের নয়।

১ জুন থেকেই আমটি খাওয়ার জন্য কেনা যেতে পারে। মধ্য জুন পর্যন্ত এই আম বাজারে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। এ আম বাজারে থাকে খুব অল্প সময়। জুন মাসের শেষ দিকে বাজারে সামান্য দেখা মিললেও সপ্তাহ শেষে একে আর বাজারে পাওয়া যাবে না সাধারণভাবে। আগাম জাতের আম হিসেবে রানিপছন্দের কদর বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি। বিশেষ করে বনেদি আমভোক্তারা তাঁদের পছন্দের তালিকায় বেশ গুরুত্বের সঙ্গেই স্থান দিয়েছেন বিশেষ এই জাতকে। ঠিক যে সময়ে গোপালভোগ আমের ভরা মৌসুম, এমনই এক সময়ে বাজারে প্রবেশ করে রানিপছন্দ। গোপালভোগের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নিজগুণে টিকে থাকে। গোপালভোগের মৌসুম শেষ হয়ে গেলেও রানিপছন্দ বাজারে ক্ষীরসাপাত ও ল্যাংড়া আমের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকে। স্বাদে ও গুণবিচারে রানিপছন্দ ও গোপালভোগের মধ্যে পার্থক্য টানা যায় না। রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর ও নওগাঁ জেলায় এ আম উৎপন্ন হয়। চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলায় রানিপছন্দ আমের চাষ হয়ে থাকে সবচেয়ে বেশি। ফলটির চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। তবে চাহিদার তুলনায় এই আমের সরবরাহ কম। আমটি সহজে চেনার উপায় হচ্ছে, উন্নত জাতগুলোর মধ্যে রানিপছন্দ সবচেয়ে ছোট এবং গোলাকার। এর সম্মুখের কাঁধ অনেক বেশি স্ফীত। শীর্ষদেশ গোলাকার।

লেখক: নদী ও স্থানীয় ইতিহাসবিষয়ক গবেষক