জাকাতের টাকায় থ্যালাসেমিয়া রোগীর জীবন বাঁচছে

থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশন হাসপাতালে ভর্তি ছোট্ট তাসমিন। শান্তিনগর, ঢাকা, ২৮ মে। ছবি: আবদুস সালাম
থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশন হাসপাতালে ভর্তি ছোট্ট তাসমিন। শান্তিনগর, ঢাকা, ২৮ মে। ছবি: আবদুস সালাম

সামিউলের বয়স ৭ বছর। সে থ্যালাসেমিয়ার রোগী। প্রতি মাসে ছোট সামিউলের শরীরে এক ব্যাগ রক্ত দিতে হয়। আর শরীরে রক্ত দিতে ভালুকা থেকে মায়ের সঙ্গে সে ঢাকায় আসে ৩০ চামেলীবাগ, শান্তিনগরে অবস্থিত থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশন হাসপাতালে।

সামিউলের মা নাসরিন জানালেন, ‘ওর শরীরের রক্ত কমতে থাকলে খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দেয়। মাথা ঘুরে। বমি করে। ও তো প্রতিবন্ধীর মতোই, তেমন কোনো কাজও করতে পারে না। তবু রক্তটা দিলে ওর শরীরটা একটু চাঙা হয়। ছেলেটা জীবিত, এইটাই বড় শান্তি। রক্ত আর ওষুধ না দিতে পারলে ছেলেটারে আর বাঁচানো যাইবো না, মইরা যাইবো।

আজ মঙ্গলবার সকালে থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশন হাসপাতালে শুধু সামিউল নয়, তাসনিম, তাশফিয়া, মালিহা, সাব্বিরসহ অনেকের অভিভাবকের সঙ্গে কথা হলো। কেউ এসেছে বাবার সঙ্গে। কেউ মায়ের সঙ্গে। কেউ বা নানির সঙ্গে। ছোট ভাই বা বোনও আছে কারও কারও সঙ্গে। রঙিন টেলিভিশনে মোটু পাতলু কার্টুন হচ্ছে। কোনো কোনো শিশু বিষণ্ন মুখে শুয়ে আছে। আবার কেউ কেউ হাতে ক্যানোলা নিয়েই কার্টুন দেখে হেসে কুটিকুটি হচ্ছে। অভিভাবকদের মুখে স্বস্তি থাকলেও হাসি নেই। পরের মাসে আবার রক্তের সংস্থান করতে হবে। তা না করতে পারলেই...।

সামিউলের মা নাসরিন জানালেন, চার মেয়ের পর এই ছেলের জন্ম। এখন মাঝে মাঝে ছেলের কষ্ট দেখে মনে হয় এই ছেলের জন্ম না হলেই ভালো ছিল। সামিউলের বাবা নজরুল রাজধানীর মহাখালীতে একটি প্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তারক্ষীর দায়িত্ব পালন করেন। এক মেয়ের বিয়ে হয়েছে। এক মেয়ে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। অন্যরা পড়াশোনা করছে।


সামিউলকে নিয়ে নাসরিন এবার ঢাকায় এসেছেন গত বৃহস্পতিবার। রোজার জন্য দাতা পেতে অনেক সমস্যা হয়। দাতা পাওয়ার পর সব পরীক্ষা নিরীক্ষা করে আজ থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশন হাসপাতালে এসেছেন। রক্ত দিতে প্রায় চার ঘণ্টার মতো লাগবে। নাসরিন পুরান ঢাকায় এক আত্মীয়ের বাড়ি উঠেছেন। বাড়ি ফিরতে ফিরতে বুধবার। বাড়িতে অসুস্থ মায়ের জিম্মায় মেয়েদের রেখে আসায় নাসরিনকে বাড়তি দুশ্চিন্তা করতে হয়। প্রতি মাসে ঢাকায় আসা যাওয়া, ছেলের ওষুধ, রক্ত সব মিলে কোনো মাসে খরচ হয় ৮ থেকে ৯ হাজার টাকা।
তবে নাসরিন জানালেন, এই ফাউন্ডেশনে গত ৩ বছরের বেশি সময় ধরে ছেলের চিকিৎসা করাচ্ছেন। ঢাকার অন্যান্য জায়গার তুলনায় এখানে খরচ অনেক কম। সব থেকে বড় কথা, এখানে ছেলে ভালো সেবা পাচ্ছে। নাসরিন বললেন,‘ আগে ঢাকারই অন্য জায়গায় ছেলেরে নিয়া যাইতাম। রক্ত ঢুকাইলেই হইলো, ছেলে কষ্ট পাইতেছে কি না তা চিন্তা করত না। এই খানে ছেলে যাতে কষ্ট না পায় তাও চিন্তা করেন স্যারেরা। তাই একটু শান্তি পাই।’

থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত তাশফিয়ার সঙ্গে কথা বলছেন এক নার্স। শান্তিনগর, ঢাকা, ২৮ মে। ছবি: আবদুস সালাম
থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত তাশফিয়ার সঙ্গে কথা বলছেন এক নার্স। শান্তিনগর, ঢাকা, ২৮ মে। ছবি: আবদুস সালাম

থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশন হাসপাতালের দেওয়া তথ্য বলছে, গত কয়েক বছর ধরেই তারা জাকাত ফান্ড গঠন করে থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত রোগীদের বিনা মূল্যে বা স্বল্পমূল্যে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছে।
থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশন হাসপাতালের উপদেষ্টা চিকিৎসক আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘ফাউন্ডেশন জাকাতের যে টাকা পাচ্ছে তা দিয়ে মানুষের জীবন বাঁচছে। এই রোগীদের প্রতি মাসে কম করে হলেও শরীরে এক থেকে দুই ব্যাগ রক্ত দিতে হয়। এই রোগের যে ওষুধ তা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এই রোগীদের নিয়মিত রক্ত আর চিকিৎসা সেবা না দিলে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব না। আর পরিবারকে একেকজন রোগীকে নিয়ে জীবনব্যাপী বা দীর্ঘমেয়াদি সংগ্রাম করতে হচ্ছে। এই সংগ্রামে সহায়তা করছে জাকাতের টাকা। স্বল্প মূল্যে বা বিনা মূল্যে রোগীর চিকিৎসা করানো সম্ভব হচ্ছে।’

ছেলে সাব্বির মাহমুদের সঙ্গে ঘুমাচ্ছেন মো. মিজান। সাব্বির থ্যালাসেমিয়া রোগী। শান্তিনগর, ঢাকা, ২৮ মে। ছবি: আবদুস সালাম
ছেলে সাব্বির মাহমুদের সঙ্গে ঘুমাচ্ছেন মো. মিজান। সাব্বির থ্যালাসেমিয়া রোগী। শান্তিনগর, ঢাকা, ২৮ মে। ছবি: আবদুস সালাম

আমিনুল ইসলাম প্রথম আলোর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, ‘গত বছর প্রথম আলোতে ফাউন্ডেশনকে জাকাতের টাকা দেওয়ার আহ্বান সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। সেই সংবাদের পর বিভিন্ন মহল থেকে ব্যাপক সাড়া পাই। গত বছরের ধারাবাহিকতায় এ বছরও ওই ব্যক্তি-সংগঠন জাকাতের টাকা দিয়েছেন, যা দিয়ে অনেকগুলো অসহায় পরিবারের মুখে হাসি ফোটানো সম্ভব হবে।’
ফাউন্ডেশনের হিসাব বলছে, গত বছর ৯৬ লাখ টাকা জাকাত সংগৃহীত হয় যা দিয়ে ৪০৮ জন রোগীকে প্রায় ২০০০ বার বিনা মূল্যে চিকিৎসা ও ওষুধ প্রদান করা হয়েছে।

অসুস্থ সামিউলের পাশে তার মা। শান্তিনগর, ঢাকা, ২৮ মে। ছবি: আবদুস সালাম
অসুস্থ সামিউলের পাশে তার মা। শান্তিনগর, ঢাকা, ২৮ মে। ছবি: আবদুস সালাম

থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশন হাসপাতালে গড়ে প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০ জন রোগী থাকে। এই রোগীদের ৯০ শতাংশের বেশি দরিদ্র। ঢাকার বাইরে থেকে আসা এই রোগীদের বেশির ভাগই শিশু। ফলে সন্তানের সঙ্গে বাবা-মা, নানিসহ যে কোনো স্বজনকে আসতে হয়। পরিবারে ছোট সন্তান থাকলে বাবা-মা তাকেও সঙ্গে আনতে বাধ্য হন। বাবা-মায়ের কাজ কামাই দিতে হয়। ঢাকায় এসে রক্ত দিতে কম করে হলেও একদিন থাকতে হয়। পরিবারে থ্যালাসেমিয়া রোগী থাকলে তার পেছনে মাসিক কম করে হলেও পাঁচ হাজার টাকা লাগে শুধু চিকিৎসা খাতে।
২০০২ সাল থেকে ফাউন্ডেশনটি যাত্রা শুরু করেছে। ফাউন্ডেশনটিতে বর্তমানে নিবন্ধিত রোগীর সংখ্যা প্রায় ৩ হাজার। ফাউন্ডেশনের দেওয়া হিসাব বলছে, দেশে ১ কোটি ১০ লাখ মানুষ থ্যালাসেমিয়ার বাহক। আর রোগীর সংখ্যা ৬০ হাজার। স্বামী এবং স্ত্রী দুজনই থ্যালাসেমিয়ার বাহক হলে সন্তানের শতভাগ সম্ভাবনা থাকে থ্যালাসেমিয়া হওয়ার। তাই বিয়ের আগে রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে হবু স্বামী-স্ত্রী রোগটির বাহক কি না তা যাচাই করার পরামর্শ দিলেন চিকিৎসক আমিনুল ইসলাম।
থ্যালাসেমিয়া রোগী ও তার পরিবারের স্বজনদের মুখে হাসি ফোটাতে বা একটু খানি স্বস্তি দিতে ফাউন্ডেশনের জাকাত ফান্ডে সাহায্য করার ঠিকানা-
বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশন (জাকাত ফান্ড),হিসাব নং- ১০০৭২৭৬২৯৩০০১, আইএফআইসি ব্যাংক, শান্তিনগর শাখা। বিকাশের মাধ্যমে দান করতে ০১৭২৯২৮৪২৫৭ নম্বরে টাকা পাঠাতে হবে (মার্চেন্ট অ্যাকাউন্ট)। এ ছাড়া অনলাইনে ভিসা বা মাস্টারকার্ডের মাধ্যমে দান করতে ভিজিট করতে হবে www.thals.org/zakat এই ঠিকানায়।
কেউ চাইলে থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশনে এসে নগদ টাকা দিয়েও সহযোগিতা করতে পারেন।