দিনাজপুর-পঞ্চগড়ে আয়করের দুই কোটি টাকা লোপাট

দিনাজপুর ও পঞ্চগড়ে জনগণের আয়করের টাকা সরকারি হিসাবে জমা না করে একটি চক্র দীর্ঘদিন ধরে কৌশলে আত্মসাৎ করেছে। এ নিয়ে দিনাজপুরে দুটি এবং পঞ্চগড়ে একটি মামলা করেছে আয়কর বিভাগ। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দিনাজপুর সমন্বিত কার্যালয়ের অভিযানেও আয়করের টাকা আত্মসাতের সত্যতা পাওয়া গেছে।

দিনাজপুরে দায়ের করা মামলার আসামিরা হলেন রংপুর কর অঞ্চল সার্কেল-৮–এর প্রধান সহকারী আবদুল মজিদ, কম্পিউটার অপারেটর মো. ওবায়দুর রহমান, আইনজীবীর সহকারী আশিক ওরফে আতিক, সোনালী ব্যাংকের দিনাজপুর শাখার কর্মকর্তা (ক্যাশ) মো. হাবিব, রংপুর কর অঞ্চল-৯–এর অস্থায়ী অফিস সহকারী নিরেন চন্দ্র রায় এবং আপেল, সার্কেল-৯–এর উচ্চমান সহকারী মো. জাহেদ উদ্দিন, মো. রফিকুল ইসলাম এবং অফিস সহায়ক মো. মোকাররম হোসেন। এ ছাড়া অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে ৮-১০ জনকে।

দুদকের দিনাজপুর সমন্বিত কার্যালয়ের উপপরিচালক আবু হেনা আশিকুর রহমানের নেতৃত্বে একটি দল অভিযান চালিয়ে গতকাল মঙ্গলবার সাতজনকে গ্রেপ্তার করেছে। গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন আবদুল মজিদ, মো. হাবিব, নিরেন চন্দ্র রায়, আক্তারুজ্জামান ওরফে আপেল, মো. রফিকুল ইসলাম, মো. ফিরোজ জামান ও রাজেকুল ইসলাম।

পঞ্চগড়ে দায়ের করা মামলার আসামিরা হলেন রংপুর কর অঞ্চল সার্কেল-১৮–এর কম্পিউটার অপারেটর মো. ওবায়দুর রহমান, সার্কেল-১৪–এর উচ্চমান সহকারী মো. রফিকুল ইসলাম, সার্কেল-১৬–এর অফিস সহকারী মো. মাসুদ রানা, সার্কেল-৪–এর উচ্চমান সহকারী মো. ফিরোজ জামান, সার্কেল-২০–এর অফিস সহকারী মো. জালাল উদ্দিন, নিরাপত্তাপ্রহরী রাজেকুল ইসলাম এবং ঝাড়ুদার আবদুস সাত্তার। এ ছাড়া ২০১২ সালের ৬ সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৯ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সোনালী ব্যাংকের পঞ্চগড় শাখায় কর্মরত সংশ্লিষ্ট দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মামলায় আসামি করা হয়েছে।

আয়কর বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ওই বিভাগে কর্মরত আসামিদের সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।

দুদকের দিনাজপুর সমন্বিত কার্যালয় থেকে জানা গেছে, নিয়ম অনুযায়ী পে অর্ডারের মাধ্যমে আয়কর সরকারি কোষাগারের নির্ধারিত কোডে সোনালী ব্যাংকের দিনাজপুর করপোরেট শাখায় জমা করার কথা। কিন্তু অসাধু চক্রটি ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে পে অর্ডারগুলো দিনাজপুর কর অঞ্চল সার্কেল-৮ এবং সার্কেল-৯–এর কর্মচারীদের বেতন–ভাতা পরিশোধসংক্রান্ত চলতি হিসাবে জমা করেন। এরপর চক্রটি যোগসাজশে জালিয়াতির মাধ্যমে ওই টাকা উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেন। দুদকের দিনাজপুর সমন্বিত কার্যালয়ের উপপরিচালক আবু হেনা আশিকুর রহমান গত ২৮ ফেব্রুয়ারি দিনাজপুরে সোনালী ব্যাংকের করপোরেট শাখায় অভিযান চালিয়ে ৩৯ লাখ ৯৪ হাজার ৬৪৩ টাকা আত্মসাতের প্রমাণ পান।

মামলার বাদী দিনাজপুর সার্কেল-৮–এর সহকারী কর কমিশনার নাজনীন আকতার নিপা এজাহারে উল্লেখ করেন, গত ২৫ এপ্রিল সোনালী ব্যাংকের দিনাজপুর করপোরেট শাখার এক কর্মকর্তা টেলিফোনে তাঁকে জানান যে, কিছু পে-অর্ডার ব্যাংকের চলতি হিসাবে জমা দেওয়ার জন্য আনা হয়েছে। পে-অর্ডারগুলো ঘষা–মাজা করা। এরপর তৎক্ষণাৎ সেগুলো জব্দ করা হয়। ওই দিনই চলতি হিসাবের লেনদেন বন্ধ করে দিয়ে নাজনীন আকতার বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানান। এরপর জালিয়াতির বিষয়টি ধরা পড়ে।

পঞ্চগড়ে টাকা আত্মসাতের ঘটনায় ১৬ মে মামলা করেন সার্কেল-২০–এর সহকারী কর কমিশনার আফরোজা বেগম। ওই মামলা সূত্রে জানা গেছে, আসামিরা যোগসাজশে ২০১২ সালের ৬ সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৯ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১ কোটি ৬৪ লাখ ৬৯ হাজার ৭৯১ টাকা আত্মসাৎ করেছেন।

নাজনীন আকতার প্রথম আলোকে বলেন, প্রতারক চক্রটি করদাতাদের পে-অর্ডারগুলোর পেছনের সরকারি কোষাগারের নির্ধারিত কোড নম্বরটি ঘষামাজা করে দিনাজপুর কর কার্যালয়ের কর্মচারীদের বেতনের চলতি হিসাব নম্বরটি বসিয়ে দেয়। সেই সঙ্গে চালনটি ছিঁড়ে ফেলে নতুন চালান ফরমে কর্মকর্তাদের জাল সিল ও স্বাক্ষর বসানো হয়। এরপর পে-অর্ডারগুলো কর্মচারীদের বেতন বিলের হিসাব নম্বরে জমা দেওয়া হয়। তারপর বেতন–বিল উত্তোলনের জন্য যে চেক দেওয়া হয়, সেই চেকে টাকার পরিমাণ কৌশলে পরিবর্তন করে তা তুলে নেয়। এভাবে দিনাজপুরে প্রতারক চক্রটি ২০ মে ২০১৮ থেকে ২৯ জানুয়ারি ২০১৯ পর্যন্ত ৩৩ লাখ ৯৪ হাজার ৪২২ টাকা আত্মসাৎ করে।

পঞ্চগড়েও একইভাবে টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে জানান সার্কেল-২০–এর সহকারী কর কমিশনার আফরোজা বেগম।

এদিকে সোনালী ব্যাংকের দিনাজপুর করপোরেট শাখা এবং পঞ্চগড় শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের কাছে মৌখিক এবং লিখিতভাবে প্রয়োজনীয় তথ্য ও সহযোগিতা চেয়েছিলেন দুই জেলার আয়কর কর্মকর্তারা। কিন্তু সোনালী ব্যাংকের দুই শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা কোনো সহযোগিতা করেননি বলে অভিযোগ করেছেন নাজনীন আকতার এবং আফরোজা বেগম।

জানতে চাইলে সোনালী ব্যাংকের দিনাজপুর অঞ্চলের উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) মো. রশিদুল ইসলাম ২৩ মে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি তিনি শুনেছেন। মামলার বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না। তা ছাড়া তদন্ত ছাড়া ব্যাংক জড়িত কি না, এটা বলা যাবে না। চলতি হিসাবে পে-অর্ডারও জমা হয়। আয়কর বিভাগ কী ধরনের সহযোগিতা চেয়েছে, তা তিনি জানেন না।

সোনালী ব্যাংকের পঞ্চগড় শাখার জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক মো. মতিয়ার রহমান ২৪ মে দুপুরে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, এ ঘটনায় ব্যাংক তদন্ত কমিটি করেছে। মামলা হওয়ায় বিচারাধীন বিষয়ে তিনি বক্তব্য দিতে চান না। কর কার্যালয় যে তথ্য চেয়েছে, তা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কোনো নির্দেশনা না দেওয়ায় তথ্য দেওয়া সম্ভব হয়নি।