গ্রাহক সেবায় সেরা

ব্যাংকের কোন টেবিলে তাঁর কাজ, এটা না বুঝে কোনো গ্রাহক যেকোনো একজন কর্মকর্তার টেবিলের সমানে বসে গেলেই হলো। সেখানে বসিয়েই তাঁকে সব ধরনের সেবা দেওয়া হচ্ছে। সময় লাগলে প্রয়োজনে গ্রাহককে এক কাপ চা দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। রূপালী ব্যাংকের রুয়েট শাখার এই সেবাদান পদ্ধতির নাম দেওয়া হয়েছে ‘ওয়ান–স্টপ সার্ভিস’। এ ছাড়া রয়েছে বিরতিহীন সেবা অর্থাৎ দুপুরের খাওয়ার বিরতির সময়ও বিশেষ ব্যবস্থায় সেবা।

গ্রাহকদের মন জয় করতে শাখার রয়েছে আরও কিছু অভিনব উদ্যোগ। কেউ হয়তো শুধুই এক দিনের জন্য ব্যাংকে টাকা রাখতে চান কিন্তু তাঁর কোনো হিসাব নম্বর খোলা নেই। তাঁর জন্য রূপালী ব্যাংকের এই শাখার দুয়ার খোলা রয়েছে। কোনো বিশেষ দিনে তারা গ্রাহকদের ফুল দিয়ে শুভেচ্ছাও জানায়। ব্যাংকের এই শাখার কর্মকর্তারাও ব্যবস্থাপকের সঙ্গে একমত হয়ে সমানে এই কাজকে ব্রত হিসেবে নিয়েছেন। তাঁরা চান গ্রাহককে সেবা দিয়ে হাসিমুখে ব্যাংক থেকে বিদায় করতে।

এ ধরনের ব্যতিক্রমী উদ্যোগের জন্য রূপালী ব্যাংক লিমিটেডের রুয়েট (রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়) শাখা সারা দেশে সেবা ও ব্যবসায়ে সেরা শাখার স্বীকৃতি পেয়েছে। শাখাটি রয়েছে দেশের সেরা পাঁচের মধ্যে। শ্রেষ্ঠ শাখা ব্যবস্থাপক পুরস্কার পেয়েছেন ব্যবস্থাপক সোয়াইবুর রহমান খান। এটি ছিল ২০১৭ সালের ভালো কাজের স্বীকৃতি। ২০১৮ সালে পুরস্কারটি দেওয়া হয়েছে।

শাখা সূত্রে জানা গেছে, রূপালী ব্যাংকের এই শাখার ৫০০ ঋণগ্রহীতা রয়েছেন কিন্তু কোনো শ্রেণিকৃত ঋণ নেই, অর্থাৎ কোনো খেলাপি ঋণ নেই। আদায়ের হার শতভাগ। সেবার পাশাপাশি এই ব্যাংকে আধুনিক সব ধরনের ব্যাংকিং–সুবিধা রয়েছে। যেমন আরটিজিএসের মাধ্যমে যেকোনো ব্যাংকে দিনে দিনেই কোনো খরচ ছাড়া টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা রয়েছে। একইভাবে রয়েছে বিইএফটিএন ও মোবাইল ব্যাংকিং–সুবিধা। পয়লা বৈশাখের পরে যেদিন ব্যাংক খুলল, সেদিন এই শাখায় গিয়ে দেখা যায়, গ্রাহকদের ফুলেল শুভেচ্ছা জানানো হচ্ছে। ব্যাংকে কাজে এসে নতুন বছরের ফুলেল শুভেচ্ছা পেয়ে তাঁদের চোখেমুখেও দেখা গেল খুশির ঝিলিক।

ব্যাংকের এই শাখার সেবার ধরন নিয়ে কথা বলতে গিয়ে রাজশাহী নগরের হড়গ্রাম এলাকার রেহেনা খাতুন বলেন, তিনি একটি জমি বিক্রি করেছিলেন। এই টাকা দিয়ে পরের দিনই একটি কাজ করবেন। কিন্তু এক রাতের জন্য টাকাগুলো বাড়িতে রাখা নিরাপদ মনে হচ্ছিল না। এক রাতের জন্য টাকাগুলো ব্যাংকে রাখবেন। কিন্তু শহরের কোনো ব্যাংকেই তাঁর কোনো হিসাব নম্বর খোলা ছিল না। শুধু এক দিনের জন্য কোনো ব্যাংকই একটি হিসাব খুলে দিতে চায় না। তিনি খোঁজ পান নগরের রূপালী ব্যাংকের রুয়েট শাখায় এ ধরনের সহযোগিতা করা হয়। রেহেনা তাঁর দুই বোনকে সঙ্গে করে ওই শাখায় যান। সঙ্গে সঙ্গে ওই ব্যাংকের পক্ষ থেকে তাঁদের একটি হিসাব খুলে দেওয়া হয়। এই সহযোগিতা পেয়ে প্রায় নিরক্ষর রেহেনা খাতুন মুগ্ধ হয়ে যান। পরে তিনি ব্যাংক হিসাবটি বন্ধ করেননি।

এভাবেই সরকারি ব্যাংকের এই একটি শাখা সেবা দিয়ে গ্রাহকের মন জয় করছে। ব্যাংকের কর্মকর্তারা মনে রাখেন, এই শাখার বেশির ভাগ গ্রাহকই উচ্চশিক্ষিত। শিক্ষকেরা বিদেশ থেকে ডিগ্রি নিয়ে এসেছেন। তাঁরা বিদেশে ব্যাংকের সেবা সম্পর্কে সচেতন। তাঁদেরও সেবা দিয়ে সন্তুষ্ট রাখতে হবে। এই সেবা সচল রাখতে প্রতিদিন সকালে নির্ধারিত সময়ে শাখায় ঢুকে তাঁরা একটি সভা করে নেন।

সম্প্রতি ব্যাংকের ওই শাখায় গিয়ে দেখা গেল, অন্যান্য ডেস্কে ভিড় থাকায় ব্যবস্থাপকের কক্ষেই গিয়ে বসেছেন কয়েকজন গ্রাহক। তাঁদের মধ্যে একজন হচ্ছেন রুয়েটের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগের শিক্ষক শহীদুজ্জামান। তিনি বললেন, ‘এই শাখার মতো সেবা নিয়ে আমরা খুবই সন্তুষ্ট। আমরা বিদেশেও দেখে এসেছি। বলতে পারেন, এ রকম সার্ভিস আমরা অন্য কোথাও গিয়ে পাই না।’ এই শাখার কাজে একই ধরনের সন্তুষ্টির কথা প্রকাশ করেন রুয়েটের যন্ত্রকৌশল বিভাগের শিক্ষক শাহেদ হাসান খান।

ব্যাংকের এই শাখায় বিশেষ সেবা দিতে গিয়ে কেমন বোধ করেন, জানতে চাইলে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা মরিয়ম নেছা বলেন, ‘ব্যাংকের মক্কেলদের কাজকে নিজের কাজ মনে করে করি। আন্তরিকভাবে রিসিভ (গ্রহণ) করি। তাঁরাও এসে বলেন, “বিরক্ত করতে এলাম।” ভালো লাগে।’

 দেখা গেল, ব্যাংকের সব কর্মকর্তা-কর্মচারী ড্রেস কোড মেনে চলেন। শাখাটিও যেন ড্রেসকোডের মতো করেই সবুজায়ন করা হয়েছে। সাজানো হয়েছে সবুজ গাছ দিয়ে।

ব্যাংক ব্যবস্থাপক সোয়াইবুর রহমান খান বলেন, ‘সেবাদানকারী রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এ রকম একটি ধারণা প্রচলিত রয়েছে যে সেখানে ঠিকমতো সেবা মেলে না। মানুষের এই ধারণাটি পাল্টে দেওয়ার জন্য ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) একটি স্লোগান আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছে। এমডি বলেন, “একটা পর্যায় পর্যন্ত আমরা বাবা–মায়ের পরিচয়ে পরিচিত হই। এরপর প্রতিষ্ঠানের পরিচয়ে পরিচিত হই। তখন মা-বাবার পরিচয়ের জায়গাটি প্রতিষ্ঠানের দখলে চলে যায়। সন্তান হিসেবে মা-বাবাকে আমরা সেবার দৃষ্টি থেকে যেভাবে দেখি, প্রতিষ্ঠানকেও সেই জায়গা থেকে দেখতে হবে। প্রতিষ্ঠানটা আমার মায়ের মতো।” এ কথা ভেবেই কাজ করি। এই ব্রত নিয়ে কাজ করতে গিয়েই এই জায়গায় এসেছি।’

ব্যাংকের পরিদর্শন বইয়ে উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম লিখেছেন, ‘সোনার ছেলেমেয়ে দেখে গেলাম। রূপালী ব্যাংকের আঙিনায় সেই সোনালি দিন আবার ফিরে আসবে। এ বিশ্বাস পেলাম এখানে এসে।’

ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. আতাউর রহমান প্রধান এসে লিখেছেন, ‘শাখা ব্যবস্থাপকের কাজের গতিশীলতায় আমি মুগ্ধ।’