স্বজনদের জন্য বন্দীদের উপহার

চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দীরা তৈরি করছেন শিশুদের খেলনা। সম্প্রতি তোলা।  সংগৃহীত
চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দীরা তৈরি করছেন শিশুদের খেলনা। সম্প্রতি তোলা। সংগৃহীত

মাদক মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে দেড় মাস ধরে কারাগারে মো. নয়ন। চার দেয়ালের ভেতরই তাঁকে ঈদ করতে হবে। গত বছর ছেলে, স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে কেনাকাটা করেছেন। এবার তাঁদের মার্কেটে নিতে না পারলেও পছন্দের ঈদ উপহার পাঠিয়েছেন নয়ন। সাড়ে তিন বছর বয়সী ছেলে মো. মানিকের জন্য কাঠের তৈরি একটি খেলনা বিমান ও স্ত্রী পারভীন আক্তারের জন্য পুঁতির তৈরির হাত ব্যাগ ঈদ উপহার পাঠান তিনি। এগুলো কোনো মার্কেট থেকে কেনেননি নয়ন। কারাগারের ভেতর থেকে কেনেন। গত বৃহস্পতিবার সাক্ষাৎ করতে আসলে স্ত্রী–সন্তানদের হাতে উপহার তুলে দেন নয়ন। কারাবন্দী স্বামীর কাছ থেকে উপহার পেয়ে খুশি তাঁরা।

শুধু বন্দী নয়ন নন, বন্দীদের তৈরি জিনিসপত্র কিনে অন্য বন্দীরা স্বজনদের কাছে পাঠাচ্ছেন। জুতা, কাঠের তৈরি বড় নৌকা, তাজমহল, হাতি, ঘোড়াসহ বিভিন্ন রকমের শো পিস, টিস্যু বাক্স, নারীদের হাত ব্যাগ (পার্টস) কারাগারে তৈরি করছেন বন্দীরা। বিক্রির টাকা থেকে খরচ বাদ দেওয়ার পর লাভটাকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। এর অর্ধেক পান যে বন্দী কাজ করেছেন। বাকিটা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া হয়। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে এসব জিনিস তৈরি করছেন বন্দীরা। বর্তমানে এই কাজের সঙ্গে ৪০০ বন্দী যুক্ত।

কারাগার থেকে নগরের কোতোয়ালি থানায় আদালতে হাজিরা দিতে আসেন নয়ন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, স্ত্রী–সন্তানকে ঈদের উপহার কারাগারে বসে নিজের পছন্দে দিতে পারায় অনেক খুশি। হাজতি (মামলায় সাজা হয়নি) হলেও কারাগারে তিনি শো পিস তৈরির কাজ করেন। সেখান থেকে টাকাও পান। এই টাকা দিয়ে পরিবারকে ঈদ উপহার দেন।

নগরের হালিশহর থানার একটি হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে নয় মাস ধরে কারাগারে আছেন জাহিদ হোসেন। স্ত্রী কুলসুম আক্তারের জন্য হাত ব্যাগ কিনে ঈদ উপহার দিয়েছেন তিনি। গত বছর ঈদের আগে তিনি স্ত্রীকে নিয়ে আগ্রাবাদ ব্যাংকক মার্কেট থেকে কেনাকাটা করেছিলেন। এবার স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে কেনাকাটা করতে না পারলেও নিজের পছন্দের জিনিস ঈদ উপহার দিতে পেরে খুশি তিনি।

কারা সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের সূর্যসেন ভবনের উৎপাদন শাখায় ৪০০ বন্দী বিভিন্ন রকমের শো পিস, জুতা তৈরির কাজ করছেন। কারাগারে আসার আগে তাঁরা এসব তৈরির কাজ জানতেন না। গত ফেব্রুয়ারি মাসে কারা কর্তৃপক্ষ এসব জিনিস তৈরির কাজ শেখার প্রশিক্ষণ শুরু করলে কয়েদি (যাঁদের সাজা হয়েছে), হাজতি বন্দীরা নিজ আগ্রহে প্রশিক্ষণ নেন। এরপর তাঁরা নিজেরাই এসব তৈরি শুরু করেন। কারা কর্মকর্তা–কর্মচারী ও বন্দীরাই তৈরি এসব জিনিসপত্র কিনছেন। এক জোড়া জুতা তৈরিতে খরচ পড়ে ৪০০ টাকা। আর এটি বিক্রি করা হয় ৬০০ টাকায়। লাভের টাকাটা দুই ভাগ করা হয়। এভাবে টিস্যু বাক্স উৎপাদন খরচ পড়ে ১০০ টাকা বিক্রি হয় ২০০ টাকা। পাখি ১০০ টাকা খরচ হলে বিক্রি হয় ২০০ টাকায়। বন্দীদের এসব কাজ দেখভাল করেন উৎপাদন শাখার মো. ফিরোজ, কারারক্ষী খায়রুল আলম ও মো. মাসুদ।

পুঁতির ব্যাগ ও বেত দিয়ে জিনিসপত্র তৈরির কাজ শিখেছেন অপহরণ মামলার আসামি আনিছুর রহমান। তিনি জানান, দুই বছর ধরে কারাগারে আছেন। সাড়ে তিন মাসে এই কাজ শিখেছেন। কারাগার থেকে মুক্তির পর তিনি বাইরে এসব জিনিসের দোকান দেবেন। একই স্বপ্নের কথা জানালেন মাদক মামলার আসামি মো. সেলিম। তিনি বলেন, ২১ মাস আগে কারাগারে আসেন। এর আগে কিছুই করতেন না। এবার মুক্তি পেলে এসব জিনিস তৈরি করে সুন্দর জীবন–যাপন করবেন।

চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের জ্যেষ্ঠ তত্ত্বাবধায়ক মো. কামাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, কারাগারে থাকা সব বন্দীকে পর্যায়ক্রমে এসব জিনিসপত্র তৈরির প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। যাতে মুক্তি পাওয়ার পর তাঁরা এসব করে সুন্দরভাবে চলতে পারেন। এখন বন্দীদের তৈরি জিনিসপত্র কারা কর্মকর্তা–কর্মচারী ও বন্দীরা কিনলেও পর্যায়ক্রমে বাণিজ্যিকভাবে বিক্রয় করা হবে। কারাগারকে সত্যিকার অর্থে সংশোধনাগার হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা রয়েছে।