সাগরে ডুবছে 'স্বপ্ন'

বাহাদুর ও বিল্লাল
বাহাদুর ও বিল্লাল
>
  • ৪২ বাংলাদেশির ৩৯ জন ডুবে মারা গেছেন
  • বেঁচে যাওয়া ৩ জন দেশে ফিরে এসেছেন

আফ্রিকার দেশ লিবিয়া থেকে নৌকায় করে ইউরোপের দেশ ইতালিতে পৌঁছার স্বপ্ন ছিল তাঁদের। এই স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে তাঁরা দালালদের খপ্পড়ে পড়েন। জনপ্রতি ৮ থেকে ১০ লাখ টাকার চুক্তি হয়। তাঁদের কেউ দেশ ছাড়েন গত ডিসেম্বরে, কেউবা জানুয়ারিতে। মৃত্যুঝুঁকি জেনেও ‘জীবনের মোড়’ ঘুরে যাওয়ার এই পথ বেছে নেন তাঁরা।

বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে ইতালি পৌঁছানোর যে পথ দালালেরা ঠিক করে দিয়েছিলেন, তা এ রকম—ঢাকা থেকে প্রথমে ভারত। সেখান থেকে দুবাই। তারপর তুরস্ক হয়ে লিবিয়া। উড়োজাহাজে এই পথ ভ্রমণ করলেও ঢাকা থেকে লিবিয়া পৌঁছাতে সময় লাগে প্রায় দুই সপ্তাহ। এর কারণ দুবাইতে এক সপ্তাহ থাকতে হয় তাঁদের। দুবাই থেকে লিবিয়া পৌঁছার পর সেখানে চার মাস ছিলেন তাঁরা। এরপর নৌকায় করে তাঁরা যান তিউনিসিয়ার উপকূলে। সেখান থেকে আরেক নৌকায় ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালির উদ্দেশে যাত্রা।

তবে শেষ পর্যন্ত সে স্বপ্ন পূরণ হয়নি ৪২ বাংলাদেশির। তাঁদের মধ্যে ৩৯ জন নৌকা ডুবে মারা গেছেন। ভাগ্যগুণে বেঁচে যাওয়া ৩ জন নিঃস্ব অবস্থায় ফিরে এসেছেন গত সপ্তাহে। ৯ মে ইতালি যাওয়ার পথে তিউনিসিয়ার উপকূলে ভূমধ্যসাগরে ডুবে যায় তাঁদের নৌকাটি।

দেশে ফিরে আসা দুজনের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁরা হলেন সিলেটের বিল্লাল ও কিশোরগঞ্জের বাহাদুর। তাঁরা জানান, সেদিন তিউনিসিয়ার উপকূল থেকে নৌকাটি ছাড়ার মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যে উত্তাল ঢেউয়ের কবলে পড়ে তা ডুবে যায়।

চোখের সামনে তলিয়ে যেতে থাকে মানুষ

বাহাদুর বলেন, হাওরপারের মানুষ তিনি। জন্মের পর সাঁতার কেটে বড় হয়েছেন। তাই সাগরের ঢেউয়েও সাহস হারাননি। নৌকা ডুবে যাওয়ার পর সাত ঘণ্টা কোনোভাবে ভেসে ছিলেন তাঁরা কয়েকজন। পরে একটি জেলে নৌকা তাঁদের উদ্ধার করে।

বাহাদুরের বাড়ি কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম উপজেলার আবদুল্লাহপুর গ্রামে। জামাল উদ্দিন ও দেলোয়ারা বেগম দম্পতির তিন সন্তানের মধ্যে বাহাদুর দ্বিতীয়। এলাকার এক লিবিয়াপ্রবাসীর মাধ্যমে ইতালি যাওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠেন তিনি। ৪ জানুয়ারি তিনি বাংলাদেশ ছাড়েন। গত এপ্রিলে লিবিয়া পৌঁছার পর তাঁর পরিবার সাড়ে ৪ লাখ টাকা পরিশোধ করে। এরপর ইতালি রওনা হওয়ার আগে আরও সাড়ে ৩ লাখ টাকা দেন। ৯ মে শুরু হয় ইতালিযাত্রা।

ছেলেকে ফিরে পেয়ে বাহাদুরের বাবা জামাল উদ্দিন বলেন, ‘পাগল হয়ে বিদেশ গেছে। না করলেও শোনেনি।’ মা দেলোয়ারা বেগম বলেন, ‘অনেক ক্ষতি হইছে আমরার। তারপরও পোলা আইছে, এতেই খুশি।’

বাহাদুর অভিযোগ করেন, লিবিয়ায় তাঁর ওপর শারীরিক নির্যাতন চালানো হতো। খাবার দেওয়া হতো এক বেলা। তিনি বলেন, মাদারীপুরের এক দালাল মেরাজ ও রুবেলের (বাড়ি কোথায় জানেন না) মাধ্যমে তিনি লিবিয়া যান। ওই দুজনও লিবিয়ায় থাকেন।

ছোট নৌকায় ৬৫ জনের যাত্রা

স্বপ্নের পথে ছুটতে গিয়ে জীবন বিপন্ন হওয়ার কথা শোনালেন সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার কটালপুর মুহিদপুর গ্রামের বিল্লাল। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, লিবিয়ায় পৌঁছার পর তাঁদের রাখা হয় জুয়ারা নামের একটি জায়গায়। সেখানে বিভিন্ন দেশের ৫২ জন ছিলেন তাঁরা। পরে আরও যোগ দেন ৩০ জন। জুয়ারায় পৌঁছার পর তাঁর পরিবারের কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা নেওয়া হয়। ইতালি রওনা হওয়ার আগে আরও ৪ লাখ টাকা নেওয়া হয়। তিনি জানান, ৮ মে তাঁদের ৬৫ জনকে একটি ছোট নৌকায় তোলা হয়। নৌকায় তাঁর দুই ভাতিজা ও ভাগনে ছিল। তাঁরা সাগরে ডুবে গেছেন।

বিল্লাল বলেন, সিলেটের জিন্দাবাজারের নিউ ইয়াহিয়া ওভারসিজের পরিচালক এনামুল হকের মাধ্যমে গত বছরের ডিসেম্বরের প্রথম দিকে তাঁরা চারজন ইতালি যাওয়ার চুক্তি করেন। তিনি ছাড়া বাকি তিনজন হলেন তাঁর দুই ভাতিজা আবদুল আজিজ, লিটন শিকদার ও ভাগনা আহমদ হোসেন। চুক্তি অনুযায়ী ভারত থেকে সরাসরি ইতালি যাওয়ার জন্য জনপ্রতি ৮ লাখ টাকা নির্ধারণ হয়। কিন্তু কয়েক দেশ ঘুরিয়ে তাঁদের লিবিয়ার ত্রিপোলি নেওয়া হয়। এনামুল হককে সম্প্রতি গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব।

বিল্লাল বলেন, আতঙ্ক আর ধকল এখনো কাটেনি। লিবিয়ায় এখনো অনেক বাংলাদেশি আটক আছেন। তাঁদের যেন সরকার উদ্ধার করে।

(প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন মানাউবী সিংহ, সিলেট ও সুমন মোল্লা, ভৈরব)