'হারেছ' থেকে 'হাজেরা' হওয়ার গল্প

ময়মনসিংহের হারেছ এখন রাজধানীর মতিঝিলের পোশাক বিক্রেতা হাজেরা। মা-বাবা বড় সন্তানের নাম রেখেছিলেন হারেছ। কিন্তু প্রকৃতির খেয়ালে ছোটবেলা থেকেই হারেছ মেয়েদের মতো সাজতে ভালোবাসতেন। তাই সবাই হিজড়া হিজড়া বলে জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছিল।

তবে হিজড়া হাজেরা এখন গর্ব করেই বলেন, ‘এখন আমার পাঠানো টাকায় গ্রামের সংসার চলে। আমি কারও অধীনে চলি না। আমি কর্ম করে খাই।’

ছোটবেলায় বাবা মারা গেলে সবাইকে ছেড়ে হাজেরা ঢাকায় পাড়ি জমান। ঢাকায় এসে হিজড়া সম্প্রদায়ের সঙ্গে ছিলেন কিছুদিন। পরে ব্যবসা করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন। আজ থেকে প্রায় ১৩-১৪ বছর আগে পোশাক বিক্রির ক্ষুদ্র ব্যবসা শুরু করেন। আজও চালিয়ে যাচ্ছেন। মতিঝিলে তাঁর অস্থায়ী দোকানে পাওয়া যায় মেয়েদের কুর্তি ও টি-শার্ট, ছেলেদের প্যান্ট, শার্ট ও টি-শার্ট। শাহজাহানপুরের একটি ঘর ভাড়া করে একাই থাকেন হাজেরা।

মতিঝিল এলাকার অনেকেরই পছন্দ হাজেরার পোশাক। স্থানীয় ব্যবসায়ী মো. রুবেল বললেন, ‘হাজের মানুষ ভালো। অনেক হিজড়া যেভাবে টাকা আয় করে, হাজেরা তা করেন না।’

নিজের অস্থায়ী দোকানে হাজেরা। মতিঝিল, ঢাকা, ২৯ মে। ছবি: আবদুস সালাম
নিজের অস্থায়ী দোকানে হাজেরা। মতিঝিল, ঢাকা, ২৯ মে। ছবি: আবদুস সালাম

মতিঝিলের এজিবি কলোনির এমন কেউ নেই যে হাজেরাকে চেনেন না। সবার সঙ্গে হাজেরার সুসম্পর্ক। এক যুগের বেশি সময় ধরে তিনি মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের পাশে তৈরি পোশাক বিক্রি করেন। কলোনির বাসিন্দা শহীদ রেজা বললেন, ‘ হাজেরা আমাদের কাছে এসে দোকান করে খেতে চান বলে জানালে আমরা তাঁকে অনুমতি দিই। সবাই তাঁকে ভালোবাসে। তাঁর ব্যবহারও ভালো।’

হাজেরার বয়স প্রায় ৩৬। তাঁর জন্ম ময়মনসিংহের বিদ্যাগঞ্জের চুয়ানিয়ায়। চার ভাই আর দুই বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। ছেলে হয়েও মেয়েদের মতো আচরণ করা অন্যদের ভালো লাগেনি। ছোট বেলায় মা-বাবা প্রায় লুকিয়েই রাখতেন তাঁকে। তাই আর পড়ালেখাও করা হয়নি।

হাজেরা আক্ষেপ করে বললেন, ‘আমি তো নিজে এমন হই নাই, আল্লাহ আমারে এভাবে সৃষ্টি করছেন। তখন মানুষ আমাকে ঘৃণা করত। দেখলেই বলত হিজড়া যাচ্ছে, হিজড়া যাচ্ছে।’

হাস্যোজ্জ্বল হাজেরা। মতিঝিল, ঢাকা, ২৯ মে। ছবি: আবদুস সালাম
হাস্যোজ্জ্বল হাজেরা। মতিঝিল, ঢাকা, ২৯ মে। ছবি: আবদুস সালাম

হাজেরা এখন হাসি মুখেই বলতে পারেন, ব্যবসা করে তিনি ভালো আছেন। মানুষও এখন আর ঘৃণার চোখে দেখে না। সম্মান করে। হাজেরা জানালেন, ব্যবসা করতে অনুপ্রাণিত করেছেন তাঁর মা।

যতই ভালো থাকেন, মন খারাপ পিছু ছাড়ে না হাজেরার। এখন বাড়ি যান না। এখনো গ্রামের আশপাশের অনেকেই বিরূপ মন্তব্য করেন। বললেন, ‘বাড়ির জন্য মন কাঁদে। তবে আমি চাই না আমার জন্য আমার আত্মীয়রা লজ্জা পাক।’

ফুটপাত থেকে হকার উচ্ছেদের অভিযানের কারণে বিপাকে পড়তে হয় হাজেরাকেও। গত এক বছরে প্রায় এক লাখ টাকা লোকসান গুনেছেন। তবে হাজেরা নিজেও ফুটপাত দখলমুক্ত রাখার পক্ষে। তাই ফুটপাত ছেড়ে স্থায়ী দোকান দেওয়ার কথা ভাবছেন। কিন্তু আবারও আক্ষেপ, পুঁজি তো নেই।