নতুন পাকা রাস্তায় মাটি ফেলে সংস্কার

এটি একটি পাকা রাস্তা ছিল। পাকা রাস্তায় মাটি কাটার প্রকল্প দেখানো হয়েছে। ছবিটি জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার। ছবি: প্রথম আলো
এটি একটি পাকা রাস্তা ছিল। পাকা রাস্তায় মাটি কাটার প্রকল্প দেখানো হয়েছে। ছবিটি জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার। ছবি: প্রথম আলো

জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার চরপলিশা মধ্যপাড়া পাকা সড়ক থেকে রেললাইন পর্যন্ত ইটের রাস্তা তৈরির কাজ প্রায় শেষের দিকে। অথচ এই রাস্তাটি মাটি ফেলে সংস্কার করার জন্য অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচির (ইজিপিপি) অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

ওই ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ২ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ফজলুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘চরপলিশা মধ্যপাড়া আমার এলাকা। ওই রাস্তাটি ইজিপিপি প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে।’ যেখানে নতুন ইটের রাস্তা হচ্ছে, সেখানে মাটি ফেলে কী করবেন, জানতে চাইলে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।

শুধু এই প্রকল্পই নয়, ২২ ও ২৩ মে উপজেলায় ইজিপিপির অন্তত ১০টি প্রকল্পে গিয়ে দেখা গেছে, কোথাও কোথাও পাকা রাস্তাকে প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কয়েকটি প্রকল্পের অস্তিত্ব থাকলেও গত ২৫ দিনেও কাজ শুরু হয়নি। যদিও এ প্রকল্পের মেয়াদ ৪০ দিন।

এভাবে উপজেলার জন্য বরাদ্দ ইজিপিপির প্রায় পৌনে ৩ কোটি টাকাই লোপাটের পাঁয়তারা চলছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচি (ইজিপিপি) প্রকল্পটি সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন। বছরের কর্মহীন দুটি মৌসুমে অতিদরিদ্র গ্রামীণ বেকার জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে এসব প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি)। সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যানরা হন বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি। আর ইউপি সদস্যরা হন কমিটির সদস্য।

চরবানিপাকুরিয়া ইউনিয়নের আটাবাড়ী পাকা রাস্তা থেকে আটাবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত মাটি ফেলে সংস্কারের প্রকল্প দেখানো হয়েছে। আটাবাড়ীতে গিয়ে কোনো মাটির রাস্তা পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে গ্রামের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ওই রাস্তাটি কয়েক সপ্তাহ আগে পাকা করা হয়েছে।

একই ইউনিয়নের ভাবকী বেপারীপাড়া কবরস্থানের উন্নয়নের জন্য ৭০ জন শ্রমিকের বিপরীতে ৫ লাখ ৬০ হাজার টাকার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কবরস্থানটিতে কোনো কাজ হয়নি। ওই কবরস্থান কমিটির সাধারণ সম্পাদক মো. কামাল হোসেন বলেন, ‘এই কবরস্থানের উন্নয়নে কোনো প্রকল্পের বিষয়ে আমাদের জানা নাই। এখানে সম্প্রতি কোনো উন্নয়নকাজও হয়নি।’

একই ইউনিয়নের মধ্যেরচরে জালাল উদ্দিনের বাড়ি থেকে রশিদ মুন্সীর বাড়ি পর্যন্ত মাটি ফেলে রাস্তা সংস্কারের প্রকল্প দেখানো হয়েছে। কিন্তু এখানে কোনো কাজ শুরু হয়নি।

আদ্রা ইউনিয়নের পশ্চিম আদ্রা কোরবানের বাড়ি থেকে স্লুইসগেট পর্যন্ত মাটি ফেলে রাস্তা সংস্কারের জন্য ৭০ জন শ্রমিকের বিপরীতে ৫ লাখ ৬০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ২৯ মে পর্যন্ত সেখানে কোনো কাজ শুরু হয়নি। স্থানীয় বাসিন্দা হেলাল প্রামাণিক বলেন, রাস্তাটি দিয়ে হেঁটেও যাতায়াত করা যায় না। একটু বৃষ্টি হলেই পুরো রাস্তা কাদা হয়ে যায়। দীর্ঘদিন ধরে গ্রামবাসী এ রাস্তার জন্য দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন।

স্থানীয় এক ব্যক্তি বলেন, ‘গ্রামবাসীকে বোকা বানিয়ে প্রকল্প দেখিয়ে চেয়ারম্যান-মেম্বার টাকা আত্মসাৎ করে খাচ্ছে। এক টুকরা মাটিও ফেলা হয়নি।’

একই ইউনিয়নের আমতলা পাকা রাস্তা থেকে মলিকাডাঙ্গা স্কুল হয়ে সৈয়দের বাড়ির রাস্তা মাটি ফেলে সংস্কারের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। সেখানেও কাজ শুরু হয়নি। এ প্রকল্প সম্পর্কেও কেউ কিছুই বলতে পারেননি। একই ইউনিয়নের খলিলের বাড়ির উত্তর পাশ থেকে জলিল ডাক্তারের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা মেরামতের প্রকল্প রয়েছে। এখানেও কাজ শুরু হয়নি।

আদ্রা ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) কার্যালয়ে গিয়ে চেয়ারম্যান ফজলুল করিমকে পাওয়া গেল না। মুঠোফোনে তাঁর বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি পরিষদের সচিবের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। পরে পরিষদের সচিব আশরাফ আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভাই কিসের কাজ শুরু হবে। কোথাও কাজ শুরু হয়নি। পরে হয়তো ট্রাক্টর বা ভেকু দিয়ে মাটি কাটা হবে। ২০০ টাকা দিয়ে শ্রমিক কোথায় পাব। তাই কোথাও কাজ শুরু হয়নি।’ খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলায় ইজিপিপির সব প্রকল্পেরই একই অবস্থা। কোথাও গতকাল বুধবার পর্যন্ত কাজ শুরু হয়নি।

মেলান্দহ উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন (পিআইও) কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে জানা গেছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ইজিপিপির দ্বিতীয় পর্যায়ে এ উপজেলায় ২ কোটি ৮২ লাখ ৪০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এসব প্রকল্পে ৩ হাজার ৫৩০ জন অতিদরিদ্র শ্রমিকের কাজ করার কথা রয়েছে। উপজেলার ১১টি ইউনিয়নে ৪ মে থেকে এই কর্মসূচির কাজ শুরু হওয়ার কথা ছিল।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মেলান্দহের পিআইও আবদুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের কাজ করতে বলেছি। কাজ শুরু না করলে তাঁরা টাকা পাবেন না। তাও যদি কাজ না করে, তাহলে আমি কী করব। আমি তো মাটি কেটে দিতে পারব না।’

এই প্রকল্পে কাজ না হলে টাকা কী ফেরত যাবে, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘কাজ হচ্ছে না, এই বিপদের চেয়ে টাকা ফেরত পাঠানোর বিপদ আরও বড়। টাকা ফেরত পাঠালে নেতা-কর্মী ও জনপ্রতিনিধিদের তোপের মুখে পড়তে হয়। সেটা সামাল দেওয়া অনেক কঠিন। এই প্রকল্পটির কোনো শৃঙ্খলা নাই। শ্রমিক বা প্রকল্পের তালিকা ধরে কাজ যাচাই-বাছাই করারও সুযোগ থাকে না অনেক সময়।’

জানতে চাইলে মেলান্দহ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তামিন আল ইয়ামীন বলেন, ‘প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে।’ কোথাও প্রকল্পের কাজ শুরু হয়নি, যা পিআইও নিজেও স্বীকার করেছেন, এ বিষয়টি জানালে ইউএনও বলেন, কাজ শুরু না হলে প্রকল্পের টাকা উত্তোলনের সুযোগ নেই। অনিয়মকারীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।