অস্তিত্বহীন নদীতে পানি নামাতে খালের প্রকল্প

খালের পানি নদীতে গিয়ে পড়বে। দূর হবে এলাকার জলাবদ্ধতা। আর ভূ–উপরিস্থ পানির প্রাপ্যতা বাড়বে। সেচসুবিধা পাওয়া যাবে। এসব কথা বলে খনন করা হচ্ছে খাল। কিন্তু খালের মাথায় নদীরই অস্তিত্ব নেই। আবার খালের দুই পাড়ে এখন আমবাগান আর বসতবাড়িই বেশি। তাই সেচের প্রয়োজন নেই বললেই চলে। তবু পৌনে দুই কোটি টাকা ব্যয়ে খাল কাটা হচ্ছে রাজশাহীর বাঘা উপজেলায়।

প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ)। প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক আবদুর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এলাকায় জরিপ করেই আমরা এই প্রকল্প অনুমোদন করেছি। প্রকল্প অনুমোদনের আগে এলাকার মানুষ জলাবদ্ধতায় তাঁদের দুর্ভোগের কথা বলেছেন।’ পদ্মা নদী এখন আর সেখানে নেই। যখন ছিল, উজান হওয়ায় তখনো খালের পানি নদীর দিকে যায়নি। এই দুটি ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে আবদুর রশিদ বলেন, তিনি এখন ঢাকায় রয়েছেন। এলাকায় ফিরে বিষয়টি দেখবেন।

প্রকল্পটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘রাজশাহী জেলার বাঘা, চারঘাট ও পবা উপজেলার জলাবদ্ধতা নিরসন এবং ভূ–উপরিস্থ পানির প্রাপ্যতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সেচসুবিধা সম্প্রসারণ’। এই প্রকল্পের আওতায় বাঘা উপজেলার মুর্শিদপুর থেকে নওটিকা পর্যন্ত ৮ দশমিক ২ কিলোমিটার খাল খনন করা হচ্ছে। গত ২৪ মে এই কাজের উদ্বোধন করা হয়েছে।

এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অতীতে মুর্শিদপুর গ্রামের পাশ দিয়ে বহমান ছিল পদ্মা নদী। কিন্তু দিনে দিনে বালুচর পড়েছে। বিরাট বালুচর ফেলে নদী সরে গেছে অনেক দূরে। এখন এই গ্রাম থেকে পদ্মা নদীর দূরত্ব অন্তত ৫-৭ কিলোমিটার। গ্রামের পাশ দিয়ে একটা খাল আছে। ভরাট হতে হতে সেটিও এখন প্রায় অস্তিত্বহীন। সেই খাল খননের উদ্যোগ নিয়েছে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। অথচ উত্তর দিকে খালের মাথায় এখন নদীরই অস্তিত্ব নেই। আবার এই খালের পানি কখনোই নদীর দিকে আসে না। কারণ খালের দক্ষিণ দিকে নিচু এলাকা নওটিকার বিল। অতীতে যখন এখানে নদী ছিল, তখনো পানি নদীতে নামেনি। উল্টো নদীর পানি খাল দিয়ে ঢুকে নওটিকার বিলের দিকে নেমে গেছে। তাই এই খাল খননে শুধু শুধু সরকারের অর্থ অপচয় হবে। আর এলাকায় জলাবদ্ধতা আরও বাড়বে।

গত মঙ্গলবার মুর্শিদপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, একসময় গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া পদ্মা নদী আর সেখানে নেই। সেটা এখন ধু-ধু মাঠ। তাতে চাষাবাদ চলছে। কথা হয় মুর্শিদপুর গ্রামের বাসিন্দা মাজদার রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, পদ্মা নদী অনেক আগেই এখানে বিরাট চর ফেলে দক্ষিণে সরে গেছে। এখন সেই চরে রীতিমতো চাষাবাদ হচ্ছে। খালের মাথায় নদী না থাকায় খনন করলেও পানি পদ্মা নদীতে যাওয়ার সুযোগ নেই। তিনি বলেন, ছোটবেলায় দেখেছেন পদ্মা নদীর পানিই এই খাল দিয়ে উত্তর দিকে নেমে গেছে। উত্তর দিকে নিচু বিল এলাকা থাকার কারণে বরাবরই পানি ওই দিকেই নেমে যায়। ওই দিক থেকে পানির গতিপথ কখনো দক্ষিণ দিকে ফেরানো যাবে না। একটা ভুল নকশার ওপরে এই খাল খনন করা হচ্ছে। এটা এলাকার মানুষ কেউ মেনে নিতে পারছেন না।

সংঘাতের আশঙ্কা

এলাকাবাসী বলছেন, আগে এই এলাকায় এই খালের ধারে প্রচুর আবাদি জমি ছিল। কিন্তু খাল যে দিক দিয়ে গেছে, তার পাশে এখন আবাদি জমি নেই বললেই চলে। সেসব জমিতে এখন আমবাগান আর বসতবাড়ি উঠেছে। কোথাও পুকুর কেটে নেওয়া হয়েছে। ফলে জলাবদ্ধতা নিরসনের আর দরকার নেই। নেই সেচ দেওয়ার প্রয়োজনও। এমন প্রেক্ষাপটে খাল খননের বিষয়টি কেবলই একটি আজগুবি চিন্তা।

ঢাকাচন্দ্রগাঁতি গ্রামের মোজাহার আলী বলেন, এই খালের ধারে মূল আবাদি জমি ছিল উপজেলার বারখাদিয়ার বিলে। সেখানে এখন পুকুর খনন করে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, আর কোনো আবাদি জমিই নেই। ফলে জলাবদ্ধতা নিরসন বা সেচের স্বার্থে খাল খনন হচ্ছে, এটা একটা অবাস্তব কথা।

মোজাহার আলীসহ এলাকার চার ব্যক্তি ইতিমধ্যে আদালতে মামলা করেছেন। তাঁদের দাবি, এখন যেখানে খাল খনন শুরু করা হয়েছে, সেখানে বেশির ভাগই ব্যক্তিমালিকানার জমি। নিয়মানুযায়ী ব্যক্তিমালিকানার জমি সরকারি কাজে ব্যবহার করতে হলে আগে অধিগ্রহণ করতে হবে। তেমন কিছু করেনি প্রকল্প গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠান বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। মামলার বাদী অপর তিনজন হলেন উপজেলার আরিফপুর গ্রামের তমেজ উদ্দিন, নওটিকা গ্রামের আবুল কাশেম ও নিশ্চিন্তপুর গ্রামের রবিউল ইসলাম।

তমেজ উদ্দিনের ছেলে তসলিম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের ব্যক্তিমালিকানাধীন জমির ভেতরে খাল টেনে আনা হচ্ছে। এর প্রতিবাদে তাঁরা মামলা করেছেন। মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা খাল খনন করতে দেবেন না।

এলাকাবাসী খাল খননের প্রতিবাদে ২৫ মে মানববন্ধন করেছেন। তাঁরা বলছেন, সরকার যদি একান্তই খাল খনন করতে চায়, তাহলে করতে পারে। তবে সেটা করতে হবে যেখানে খাসজমি রয়েছে সেখানে। এ ক্ষেত্রে তাঁদের কোনো আপত্তি থাকবে না। এ ছাড়া এলাকাবাসী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে গিয়েও সমস্যার কথা তুলে ধরেছেন।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বাঘার ইউএনও শাহীন রেজা ২৫ মে ঘটনাস্থলে গিয়ে খাল খনন স্থগিত রাখার নির্দেশ দিয়ে এসেছিলেন। তবে ২৮ মে ঠিকাদারের লোকজন খাল খননের পক্ষে এলাকায় মানববন্ধন করেন। এ নিয়ে এলাকায় চরম উত্তেজনা শুরু হয়েছে। স্থানীয় লোকজন আশঙ্কা করছেন, বিষয়টি নিয়ে যেকোনো সময় সহিংস ঘটনা ঘটতে পারে।

বাঘার ইউএনও শাহীন রেজা প্রথম আলোকে বলেন, তিনি আসলে এই কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নন। তবে এলাকার শান্তিশৃঙ্খলা যাতে নষ্ট না হয়, সেটা দেখার দায়িত্ব তাঁর আছে। সেই বিবেচনা থেকেই ২৫ মে ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন। তখন চার দিনের জন্য খননকাজ স্থগিত করেছিলেন। এর বাইরে তাঁর আর কিছু করার নেই।