গ্রামে তামাকের ব্যবহার বেশি

ঢাকার মহাখালীতে জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ৫ মে গৃহবধূ ফাতেমা বেগমের মুখের ভেতর অস্ত্রোপচার করা হয়। চিকিৎসকেরা বলেছেন, দীর্ঘদিন পানের সঙ্গে তামাকপাতা ও জর্দা খাওয়ায় তিনি ক্যানসার রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। একই হাসপাতালের পুরুষ ওয়ার্ডে কেমোথেরাপি নিচ্ছেন মোসলেম গাজী। তাঁর ফুসফুসে ক্যানসার ধরা পড়েছে।

মোসলেমের ছেলে খলিল উর রহমান বলেন, ধূমপানের কারণে তাঁর বাবার এই অবস্থা হয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে (গ্যাটস) ২০১৭-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার করছে প্রায় ৩ কোটি ৭৮ লাখ মানুষ। শহরের তুলনায় গ্রামের মানুষের মধ্যে তামাক ব্যবহারের পরিমাণ বেশি। অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠীর ৪৮ শতাংশ তামাক ব্যবহার করে। তবে অতি উচ্চবিত্তের মধ্যে তামাক ব্যবহারের হার ২৪ দশমিক ৮ শতাংশ। আর নারীরা ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্য বেশি গ্রহণ করেন।

বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও আজ ৩১ মে ‘বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস’ পালন করা হবে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘তামাকে হয় ফুসফুস ক্ষয়: সুস্বাস্থ্য কাম্য, তামাক নয়’। দিবসটি উপলক্ষে পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাষ্ট্রপতি বলেছেন, তামাক প্রতিরোধে সমাজের সর্বস্তরে এর ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করা অত্যন্ত জরুরি। প্রধানমন্ত্রী তাঁর বাণীতে বলেছেন, সবাই মিলে চেষ্টা করলে ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়া সম্ভব হবে।

গত ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত ‘ইকোনমিক কস্ট অব টোব্যাকো ইউস ইন বাংলাদেশ: আ হেলথ অ্যাপ্রোচ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, তামাকজাত দ্রব্য গ্রহণের কারণে বছরে দেশে ১ লাখ ২৬ হাজারের বেশি মানুষ মারা যায়। শারীরিকভাবে পঙ্গু হয় প্রায় তিন লাখ মানুষ। গবেষণাটি করা হয় ২০১৭ ও ২০১৮ সালে। এই গবেষণায় যুক্ত ছিল আমেরিকান ক্যানসার সোসাইটি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ ও বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটি।

বাংলাদেশে তামাক ও তামাকজাত পণ্যের বিক্রি বেশি হওয়ার কারণ হিসেবে এর তুলনামূলক কম দামকেই দায়ী করছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান)। তামাকবিরোধী এ সংগঠন বলছে, ভারতে সিগারেটের সর্বনিম্ন দাম বাংলাদেশের নিম্নমানের সিগারেটের চেয়ে দ্বিগুণ। ইউরোপসহ উন্নত দেশেও তামাকজাত পণ্যের দাম বেশি।

ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্যের ওপর কর বাড়ানোর জন্য বিদ্যমান কর কাঠামো পরিবর্তন করার দাবি করছে তামাকবিরোধী সংগঠনগুলো। ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্য থেকে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়ানোয় জোর দিয়েছে তামাকবিরোধী গবেষণা সংগঠন প্রজ্ঞা। সংগঠনটির হিসাবে, বাংলাদেশে বর্তমানে তামাক ব্যবহারকারীদের মধ্যে ৫০ শতাংশের বেশি মানুষ ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহার করে। তাদের অধিকাংশই দরিদ্র ও নারী। কিন্তু তামাক খাতের মোট রাজস্বের মাত্র শূন্য দশমিক ২ শতাংশ আসে ধোঁয়াবিহীন তামাক থেকে।

>

তামাকজাত দ্রব্য গ্রহণের কারণে বছরে দেশে ১ লাখ ২৬ হাজারের বেশি মানুষ মারা যায়
অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠীর ৪৮ শতাংশ তামাক ব্যবহার করে
অতি উচ্চবিত্তের মধ্যে এ হার ২৪ দশমিক ৮ শতাংশ

প্রজ্ঞার নির্বাহী পরিচালক এ বি এম জুবায়ের বলেন, ধোঁয়াবিহীন তামাক জর্দা ও গুলের উৎপাদন ও বিপণনে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।

তামাকজাত দ্রব্য থেকে সরকারের রাজস্ব আয়ও কম। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সরকারের তামাক খাত থেকে রাজস্ব আয় হয়েছে ২২ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। আর তামাক ব্যবহারের কারণে জনগণের চিকিৎসা ব্যয় ও উৎপাদনশীলতা কমে সরকারের অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকার।

তামাকপণ্যের দাম বাড়াতে শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ডের উদাহরণ কাজে লাগানোর প্রস্তাব দিয়েছে প্রজ্ঞাসহ তামাকবিরোধী বিভিন্ন সংগঠন। এসব দেশসহ অনেক দেশ তামাকপণ্যে কার্যকর করারোপে মিশ্র পদ্ধতি গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশেও সম্পূরক শুল্কের একটি অংশ সুনির্দিষ্ট আকারে আরোপ করা হলে তামাকপণ্যের দাম কার্যকরভাবে বাড়বে এবং ব্যবহার কমবে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি নতুন বাজেটের আগে এ বিষয়ে সরাসরি কোনো মন্তব্য করতে চাননি। তবে তামাকজাত পণ্যে কর বাড়ানোর ইতিবাচক সিদ্ধান্তের কথা জানান তিনি।

গ্যাটস ২০১৭-এর প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে একজন ধূমপায়ী সিগারেট বাবদ মাসে গড়ে ১ হাজার ৭৭ টাকা খরচ করে। খানা জরিপ ২০১৬ অনুযায়ী, দেশে একটি পরিবারের শিক্ষা ও চিকিৎসার জন্য প্রতি মাসে গড় ব্যয় যথাক্রমে ৮৩৫ ও ৭০০ টাকা। অর্থাৎ তামাকজাত পণ্যের পেছনে ব্যয় শিক্ষা ও চিকিৎসার ব্যয়ের চেয়ে বেশি।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) গবেষণা পরিচালক মাহফুজ কবীর বলেন, তামাকের দাম বাড়ালে সরকারের যে আয় হবে, তা তামাকের কারণে সৃষ্ট রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসাসহ সার্বিক জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে ব্যয় করা যায়। এই ব্যয় সার্বিকভাবে দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।