এক টাকায় ইফতারি

শিশুদের হাতে এক টাকায় ইফতারি দিচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবীরা।
শিশুদের হাতে এক টাকায় ইফতারি দিচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবীরা।

মধ্য আকাশ থেকে সূর্য হেলে পড়েছে পশ্চিমে। অবশ্য রোদের তেজ তাতে কমেনি। নীল রঙের পিকআপ ভ্যানটি মিরপুর পল্লবীর আরামবাগ এলাকায় ঢুকতেই একঝাঁক শিশু-কিশোর এসে ভিড় জমায় ভ্যানটির সামনে। এই ভ্যানটি তাদের বেশ চেনা। তারা জানে বিকেলের ঠিক এই সময়টায় ভ্যানটি এসে থামবে। ভ্যানের সামনে তারা লাইন দিয়ে দাঁড়াবে। ভ্যান থেকে স্বেচ্ছাসেবীরা এসে তাদের হাতে তুলে দেবেন ইফতারির একটি বাক্স। একেবারে বিনে পয়সায় নয়, দাম এক টাকা।

একজনের খাবারের উপযোগী এই এক টাকার ইফতারির বাক্সে থাকে ছোলা, মুড়ি, একটি করে পেঁয়াজি, বেগুনি, খেজুর, বিস্কুট ও সেদ্ধ ডিম। এক টাকার এই ইফতারির বাক্স দিচ্ছে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন।

সম্প্রতি এক বিকেলে হাতে এক প্যাকেট ইফতারি পেয়ে দারুণ খুশি ঝুমা। খুশি ঝুমার মা শাহানা বেগমও। প্রতিদিন ইফতারের আগে এক টাকার এই ইফতারির বাক্স স্বল্প আয়ের পরিবারের শিশু-কিশোর ও রোজাদারদের মধ্যে এক অনাবিল আনন্দ বয়ে আনে।

প্রতিবছর পবিত্র রমজান মাসের শুরু থেকেই মিরপুরের আরামবাগসহ কড়াইল বস্তি, কালশী, রূপনগর, ভাসানটেক, রায়েরবাজার এলাকায় ইফতারি দিচ্ছে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন। মূলত শিশুদের খাবার দেওয়াই তাদের লক্ষ্য, তবে বিতরণের সময় কারও কাছে টাকা না থাকলে বা বয়স্ক কেউ এলে তাদের খালি হাতে ফেরানো হয় না। এ ছাড়া রাতের বেলায় ভাষানটেক ও হাইকোর্ট মাজার এলাকায় এক টাকায় সাহ্‌রিও খাওয়ানো হয়।

সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য কাজ করে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন। তারা জানায়, ফাউন্ডেশনের কয়েকটি উদ্যোগের একটি হলো ‘এক টাকায় আহার’। ২০১৬ সাল থেকে এই কর্মসূচির মাধ্যমে তারা এক টাকায় দুস্থদের হাতে খাবার তুলে দেয়। এই কার্যক্রমের অংশ হিসেবেই রমজান মাসে ‘এক টাকার ইফতারি’ ও ‘এক টাকায় সাহ্‌রি’ বিতরণ করা হয়। শুভেচ্ছা মূল্য এই এক টাকা নেওয়া হয় যেন গ্রহীতার মনে কোনো হীনম্মন্যতা সৃষ্টি না হয়। বিদ্যানন্দ গ্রহীতাদের ভেতর ‘ভিক্ষা’ ও বণ্টনকারীদের মধ্যে ‘দান’ শব্দটি মুছে ফেলতে চায়। তারা যেন ভাবতে পারে প্রতীকী হলেও কিছু মূল্য দিয়েই খাবারটি তারা নিয়েছে। এই কর্মসূচির আওতায় খাবার পায় ১২ বছরের নিচের সুবিধাবঞ্চিত শিশু আর ৬০ বছরের বেশি হতদরিদ্র বৃদ্ধ।

প্রকল্পের স্বেচ্ছাসেবী সুলতানা জান্নাত বলেন, বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে গত রমজানে আড়াই লাখ বাক্স ইফতারি দেওয়া হয়েছে। এ বছর আরও বেশি দেওয়ার পরিকল্পনা আছে।

প্রতিদিন সকাল থেকে মিরপুর সাড়ে এগারোতে ফাউন্ডেশনের প্রধান কার্যালয়ে ইফতারির আয়োজন শুরু হয়। রান্না শেষে প্যাকেটে ভরে সেগুলো গাড়িতে করে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় নির্দিষ্ট স্থানে ঠিক ঠিক সময়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পুরো রমজানেই এই ইফতারির আয়োজন চলে। ইফতারির পাশাপাশি ঢাকার বেশ কয়েকটি জায়গায় এক টাকায় সাহ্‌রি খাওয়ানো হয়। রমজান মাস ছাড়া বছরের অন্য মাসগুলোতে রোজ ঢাকায় প্রায় আড়াই হাজার মানুষের জন্য খাবার রান্না ও বিতরণ করা হয়। এসব কাজে প্রতিদিন দেড় শর মতো স্বেচ্ছাসেবী সকাল ৬টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত একটানা কাজ করেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন ফারুক আহমেদ, সালমান খানের মতো শিক্ষার্থীরা; আবার রওশনা, নিলুফার হোসেনের মতো গৃহিণীরাও।

ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, রংপুর, রাজশাহীতেও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের মধ্যে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে এক টাকায় ইফতারি বিতরণ করা হচ্ছে।

বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা কিশোর কুমার দাশ প্রথম আলোকে জানালেন, মূলত সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের দান করা টাকা থেকেই বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের এই কার্যক্রম চলছে। ২০১৬ সাল থেকে শুরু করেন এই কার্যক্রম। এই ফাউন্ডেশনের আটটি স্থানীয় শাখাসহ ৪০ জন কর্মকর্তা আছেন। এখানে কাজ করেন শত শত স্বেচ্ছাসেবক। অনাথ ও বঞ্চিত শিশুদের মৌলিক চাহিদা মেটানোর জন্য বিদ্যানন্দ এক টাকায় আহার, রমজান মাসে এক টাকায় ইফতারির কার্যক্রম ছাড়াও বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের আছে দুস্থদের জন্য এক টাকায় চিকিৎসা। বিদ্যানন্দ শিশু নিকেতন, বিদ্যানন্দ অনাথালয়। দুস্থ নারীদের জন্য কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ প্রকল্প। দরিদ্র গর্ভবতী নারীদের জন্য এক গ্লাস দুধ কার্যক্রম, শীতকালীন ও ঈদে নতুন কাপড় বিতরণ। মাসে এক দিন বড় পর্দায় বিভিন্ন শিক্ষামূলক চলচ্চিত্র দেখানো হয়।