চাল রপ্তানির অবস্থায় নেই বাংলাদেশ

কৃষকদের ন্যায্যমূল্য এবং ধানের মূল্যবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে সরকার ১০ থেকে ১৫ লাখ টন চাল রপ্তানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রপ্তানিতে উৎসাহ দিতে ব্যবসায়ীদের দেওয়া ২০ শতাংশ প্রণোদনাও বাড়ানোর চিন্তা করছে সরকার। কিন্তু খাদ্যনীতিবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (ইফপ্রি) বলছে, বাংলাদেশ এখনো চাল রপ্তানির অবস্থায় পৌঁছায়নি। ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে সরকারকে কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ধান সংগ্রহের দিকেই এগোতে হবে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার যে পদ্ধতিতে কৃষকের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ করে, তা অনুসরণ করা যেতে পারে।

গত ২০ মে ইফপ্রির পক্ষ থেকে কৃষি মন্ত্রণালয়ের কাছে দেশের ধান-চালের দাম, কৃষি ব্যবস্থাপনা ও চালের আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়েছে, ধানের দামের ওঠানামায় গরিব ক্রেতা ও কৃষক সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ফলে সরকারের জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ ওই দুই শ্রেণির মানুষকে সুরক্ষা দেওয়া। আমন ওঠার পর গত ডিসেম্বরে প্রতি মণ ধানের দাম কমে ৫৮০ টাকায় পৌঁছায়। চলতি মে মাসে তা ৪৯৯ টাকা হয়। সংস্থাটির আশঙ্কা, বোরো পুরোপুরি কাটা হয়ে গেলে ধানের দাম আরও কমতে পারে।

এ বিষয়ে ইফপ্রি, বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ড. আখতার আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশে ধান-চালের উৎপাদন এখনো স্থিতিশীল জায়গায় পৌঁছায়নি। কোনো বছর উৎপাদন বেশি হয়, আবার কোনো বছর কমে যায়। আন্তর্জাতিক বাজারের ক্রেতারা এ ধরনের অস্থিতিশীল উৎপাদনের দেশ থেকে চাল কিনতে চাইবে না। এ ছাড়া দেশে রপ্তানিযোগ্য কী পরিমাণ চাল আছে, তার কোনো বস্তুনিষ্ঠ তথ্যপ্রমাণ নেই। উৎপাদিত চালের বাজারও খুব সীমিত। আর ওই চালের বাজার ভারত নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে বাংলাদেশ চাইলেও চাল রপ্তানি করা কঠিন হবে।

কৃষি মন্ত্রণালয়ে গত বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, ধান–চালের দাম কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত চাল আমদানি। প্রাথমিকভাবে মূলত ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে ১০ থেকে ১৫ লাখ টন চাল রপ্তানির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে দেশে উদ্বৃত্তের চেয়ে বেশি চাল যাতে রপ্তানি না হয়, তা–ও তদারক করা হবে।

দেশের ধান–চাল পরিস্থিতি নিয়ে ইফপ্রির পর্যবেক্ষণ বিষয়ে গতকাল শুক্রবার কৃষিমন্ত্রী প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিশ্ববাজারে চালের দাম এখন কম। চালকলের মালিকেরা চাল রপ্তানির জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছিলেন। আমরা সেই সুযোগ দিয়েছি। এ বছর দেশে যে অতিরিক্ত চাল আছে, তা তাঁরা রপ্তানি করতে পারলে ভালো কথা। প্রয়োজনে তাঁদের সহযোগিতা আরও বাড়াব। তবে এতে দেশে ঘাটতি দেখা দিলে বা দাম বাড়লে প্রয়োজনে ভারত বা অন্য কোনো দেশ থেকে চাল আমদানি করা হবে।’

আমদানি, রপ্তানি, সংগ্রহে লাভবান বড় মিলের মালিকেরা
অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, ধানের দাম কমে যাওয়ায় চাল রপ্তানির সিদ্ধান্তে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবেন বড় চালকলের মালিকেরা। ২০১৭ সালে হাওরে ফসল বিপর্যয়ের পর চালের দাম হঠাৎ বেড়ে গেলে সরকার চালের আমদানি শুল্ক ২৮ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ করে। এই সুবিধা কাজে লাগিয়ে চালকলের মালিক ও ব্যবসায়ীরা চাল আমদানি করেন। বাজারে ধানের দাম কমে যাওয়ার কারণে চালকলের মালিকেরা ১০ থেকে ১২ টাকা কেজি দরে ধান সংগ্রহ করছেন। আর সরকারি গুদামে প্রতি কেজি ধান ২৬ টাকা ও চাল ৩৬ টাকা কেজি দরে তাঁরা বিক্রি করবেন। ফলে তাঁদের দ্বিগুণের বেশি লাভ হচ্ছে।

বড় চালকলের মালিকদের বেশির ভাগই সরু চাল রপ্তানি করে থাকেন। এবার তাঁরা মাঝারি মানের চালও রপ্তানির সুযোগ পাবেন।

>

ইফপ্রির পর্যবেক্ষণ
প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বাংলাদেশে চাল উৎপাদন স্থিতিশীল নয়
ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ধান সংগ্রহের পরামর্শ

এ বিষয়ে বাংলাদেশ অটো, মেজর, হাসকিং ও মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এ কে এম লায়েক আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোন মিল মালিক কী পরিমাণে চাল কোন দেশে রপ্তানি করবেন, সেই যোগাযোগ ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। বিদেশে প্রায় এক কোটি বাংলাদেশি বসবাস করেন, তাঁরা ভারতীয় চাল কিনে খান। মূলত তাঁদের বাজার ধরতে আমরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চাল রপ্তানি করব। এ ছাড়া আফ্রিকার বেশ কয়েকটি দেশে আমাদের চালের চাহিদা আছে। ভারত ও শ্রীলঙ্কাতেও আমাদের চাল রপ্তানি সম্ভব।’

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষিবিষয়ক সংস্থা এফএওর চলতি মে মাসে প্রকাশিত বিশ্বের দানাদার খাদ্যের উৎপাদনবিষয়ক বৈশ্বিক প্রতিবেদন অবশ্য ভিন্ন কথা বলছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বে এ বছর ৫১ কোটি ৬৮ লাখ টন চাল উৎপাদিত হয়েছে। আর আন্তর্জাতিক বাজারে আসবে ৪ কোটি ৬৮ লাখ টন, যা গত বছরের তুলনায় সাড়ে ৪ শতাংশ বেশি। এসব চালের প্রধান আমদানিকারক দেশ হচ্ছে চীন, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন ও মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ।

আর ইফপ্রির প্রতিবেদন অনুযায়ী, বৈশ্বিকভাবে উৎপাদিত চালের মাত্র ৮ শতাংশ (সাড়ে ৩ কোটি থেকে ৩ কোটি ৭০ লাখ টন) আন্তর্জাতিক বাজারে বেচাকেনা হয়। বিশ্বের চালের বাজারে সবচেয়ে বড় বিক্রেতা ভারত। এককভাবে দেশটি প্রায় ৩৪ শতাংশ চাল রপ্তানি করে। এরপর থাইল্যান্ড প্রায় ২৮ শতাংশ, ভিয়েতনাম ১৯ শতাংশ, পাকিস্তান ১১ শতাংশ ও যুক্তরাষ্ট্র প্রায় ৯ শতাংশ চাল রপ্তানি করে। বিশ্ববাজারে আসা বেশির ভাগ চালই আতপ ও আঠাযুক্ত। বাংলাদেশে উৎপাদিত চালের ৯৫ শতাংশ সেদ্ধ শক্ত চাল। এই চালের আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা তেমন নেই। তবে বাংলাদেশ প্রতিবছর প্রায় ৫০ হাজার টন সুগন্ধি চাল মধ্যপ্রাচ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বাজারে রপ্তানি করে। মূলত প্রবাসী বাংলাদেশিরা ওই চাল কিনে থাকেন।

পশ্চিমবঙ্গে যেভাবে ধান সংগ্রহ করা হয়
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার কৃষকদের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ করে তার দাম ৭২ ঘণ্টার মধ্যে তাঁদের ব্যাংক হিসাবে পাঠিয়ে দেয়। আর গ্রাম এলাকা থেকে কৃষকের ধান সংগ্রহ করার জন্য আছে ‘সেলফ হেল্প গ্রুপ’ নামের দল। তারা কৃষকদের ধান সংগ্রহ করে জেলা খাদ্য কর্মকর্তাকে জানায়। আর রাজ্য সরকার ওই ধান প্রতি কেজি বাংলাদেশি টাকায় ২০ টাকা ৮০ পয়সা দরে সংগ্রহ করে। রাজ্য সরকার এ বছর ৫২ লাখ টন ধান সংগ্রহ করবে; যার পুরোটাই কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি সংগ্রহ করা হবে।

বাংলাদেশের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গ সরকার কৃষকদের ভর্তুকি ও সহায়তাও বেশি দেয়। সরকার বেসরকারি গুদাম ভাড়া নিয়ে তাদের ব্যবস্থাপনায় ধান সংগ্রহ করে রাখে। পরে তারা বেসরকারি মিলমালিকদের কাছ থেকে ওই ধান ভাঙিয়ে চাল করে। যেসব সেলফ হেল্প গ্রুপ কৃষকদের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ করে এনে দেয়, তাদের প্রতি এক হাজার কেজির (এক কুইন্টাল) জন্য ৩১.২৫ রুপি করে দেওয়া হয়। গুদামে বয়ে আনার জন্য পরিবহন খরচ হিসেবে অতিরিক্ত ২০ রুপি করে প্রতি কুইন্টালের জন্য দেওয়া হয়।

ইফপ্রির সুপারিশ, বাংলাদেশ সরকারের উচিত হবে বছরের শুরুতেই ধানের সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণ করে তা কৃষকদের জানিয়ে দেওয়া। এতে কৃষক কী পরিমাণ জমিতে ধান চাষ করবেন, তা তাঁরা বুঝতে পারবেন।

এ বিষয়ে কৃষিমন্ত্রী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা যত দ্রুত সম্ভব সামনের বছর থেকে ধানের সংগ্রহ মূল্য ঘোষণা করব। ধান সংগ্রহের পরিমাণ পর্যায়ক্রমে বৃদ্ধি করে ৫০ লাখ মেট্রিক টনে উন্নীত করা হবে।’

চাল রপ্তানির উদ্যোগ আগেও ছিল
এর আগে ২০১২ সালে বাংলাদেশ চাল রপ্তানির উদ্যোগ নিয়েছিল। ওই বছর চালকলের মালিক ও ব্যবসায়ীরা দেশে উদ্বৃত্ত চাল আছে—এই তথ্য তুলে ধরে রপ্তানির অনুমোদন চান। সরকার বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে (বিআইডিএস) দিয়ে এ ব্যাপারে একটি গবেষণা করায়। গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে ২০১২ সালে মোট সাত লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত ছিল। আর গড়ে প্রতিবছর বাংলাদেশে ৭ থেকে ১০ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত অথবা ঘাটতি হয়। তবে যে পরিমাণে চাল উদ্বৃত্ত থাকে, তা রপ্তানিযোগ্য নয়। ফলে বাংলাদেশ ওই বছর আর চাল রপ্তানিতে যায়নি।

২০১৪ সালে বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কায় ৫০ হাজার টন চাল রপ্তানির জন্য চুক্তি করে। কিন্তু ওই বছর এবং তার আগের বছর বাংলাদেশ ১২ থেকে ১৪ লাখ টন চাল বিদেশ থেকে আমদানি করে। পরে আর চাল রপ্তানির কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের খাদ্য উপদেষ্টা এ এম এম শওকত আলী প্রথম আলোকে বলেন, এই বছরও দেশে রপ্তানিযোগ্য চাল আছে কি না, তা আরও ভালোমতো খতিয়ে দেখা দরকার। এ জন্য সরকার একটি সমীক্ষা করে তারপর সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সরকারের উচিত হবে বিভিন্ন স্থানে প্রশাসনের পক্ষ থেকে ধান সংগ্রহের যে উদ্যোগগুলো চলছে, তাকে উৎসাহিত করা। আর চালের কম দামের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের দ্রুত সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মাধ্যমে সহায়তা পৌঁছে দেওয়া।