পদ্মা থেকে আরেক গৃহবধূর লাশ উদ্ধার

সন্তানদের বাঁচাতে গিয়ে মারা যাওয়া দুই গৃহবধূর স্বজনদের আহাজারি। ছবি: প্রথম আলো
সন্তানদের বাঁচাতে গিয়ে মারা যাওয়া দুই গৃহবধূর স্বজনদের আহাজারি। ছবি: প্রথম আলো

পদ্মা নদীতে সন্তানদের বাঁচাতে গিয়ে মারা যাওয়া দুই গৃহবধূর আরেকজনের লাশ আজ শনিবার সকালে উদ্ধার করা হয়েছে। দুই গৃহবধূর মধ্যে স্বপ্না বেগম নামে একজনের লাশ গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় উদ্ধার করা হয়। আজ শনিবার সকালে রেবেকা বেগম নামে আরেক গৃহবধূর লাশ উদ্ধার করা হয়।

গতকাল শুক্রবার বিকেলে রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়ায় পদ্মা নদীতে দুই গৃহবধূ গোসল করতে গেলে তাঁদের পিছু নিয়ে নদীর পাড়ে চলে আসে তাঁদের শিশুসন্তানেরা। তাঁদের অজান্তে এক গৃহবধূর দুই সন্তান নেমে যায় পানিতে। ওই সময় ওই শিশুদের বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ হারান দুই গৃহবধূ। স্থানীয় জেলেরা শিশু দুটিকে জীবিত উদ্ধার করতে পারলেও দুই গৃহবধূ স্রোতের টানে তলিয়ে যান।

রেবেকা বেগম (২৮) দৌলতদিয়া লঞ্চঘাটের পশ্চিমে নতুনপাড়ার সুজাত সরদারের স্ত্রী এবং প্রতিবেশী স্বপ্না বেগম চাঁদ আলী মণ্ডলের স্ত্রী।

গৃহবধূদের পরিবার ও স্বজনেরা জানান, গতকাল বিকেলে বাড়ি থেকে ২০০ গজ দূরে পদ্মা নদীতে গোসল করতে যান গৃহবধূ রেবেকা বেগম ও স্বপ্না বেগম। ওই সময় রেবেকার দুই শিশুপুত্র নীরব সরদার ও সৌরভ সরদার এবং স্বপ্নার দুই শিশুকন্যা চাঁদনি ও লামিয়া তাঁদের পিছু নেয়। দুই গৃহবধূ নদীতে নেমে গোসল শুরু করলে তাঁদের অজান্তে রেবেকার দুই ছেলে নীরব ও সৌরভ পদ্মায় নেমে পড়ে। চোখের সামনে হঠাৎ সন্তানদের ভেসে যেতে দেখে দুই গৃহবধূ একসঙ্গে শিশুসন্তান দুটিকে উদ্ধারের চেষ্টা করেন। দূর থেকে পদ্মা নদীতে মাছ ধরা অবস্থায় কয়েকজন জেলে দ্রুত এগিয়ে এসে শিশুসন্তানদের উদ্ধার করতে পারলেও গৃহবধূদের বাঁচাতে পারেননি। স্রোতের টানে পানিতে তলিয়ে যান তাঁরা।

এ সময় স্বপ্নার বড় মেয়ে চাঁদনি ছুটে গিয়ে তার বাবা চাঁদ আলী মণ্ডলকে এ খবর দেয়। খবর পেয়ে তিনি দৌড়ে পদ্মা নদীতে গিয়ে এলাকাবাসীকে সঙ্গে নিয়ে পানিতে খোঁজ করতে থাকেন। পরে উদ্ধার অভিযান শুরু করেন গোয়ালন্দ ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের কর্মীরা। প্রায় দুই ঘণ্টা পর বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে দুর্ঘটনাস্থল থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে লঞ্চঘাটের ক্যানেলের কাছে ১ ও ২ নম্বর ফেরিঘাটের মাঝামাঝি স্থানে স্থানীয় লোকজন স্বপ্নাকে ভাসতে দেখে। স্বপ্নাকে উদ্ধার করে গোয়ালন্দ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।

ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে ঢাকা থেকে যাওয়া চারজনের ডুবুরি দল উদ্ধার অভিযানে নামে। গতকাল রাত সাড়ে নয়টার পর উদ্ধার অভিযান বন্ধ ঘোষণা করে ফায়ার সার্ভিস। আজ সকাল থেকে ফের অভিযান শুরু করে। সকাল সাড়ে আটটার দিকে দুর্ঘটনাস্থলের সামান্য দূরের ভাটিতে রেবেকা বেগমের মরদেহ ভেসে উঠলে তা উদ্ধার করা হয়।

মৃত দুই গৃহবধূর বাড়িতে আজ গিয়ে দেখা যায়, চাঁদ আলী মণ্ডল ও সুজাত সরদারের পাশাপাশি বাড়ি। দুই পরিবারের লোকজন ও আত্মীয়স্বজনের কান্নায় গোটা এলাকার পরিবেশ ভারী হয়ে উঠছে। পরিবার দুটি কয়েক বছর আগে দৌলতদিয়ায় ভাঙনের শিকার হয়ে নতুনপাড়ায় এসে অন্যের জমিতে কোনো রকমে বসতি গড়েন।

দুই শিশুসন্তানকে জড়িয়ে কাঁদছিলেন স্বপ্নার স্বামী চাঁদ আলী মণ্ডল। তিনি বলেন, বাড়ির পাশে একজনের বাড়িতে দিনমজুর হিসেবে কাজ করছিলেন। বড় মেয়ে চাঁদনি দৌড়ে এসে জানায়, ‘বাবা গাঙ্গে দারে (স্রোত) টেনে নিছে মারে ও চাচিরে।’

পাশেই চিৎকার করে কাঁদছিলেন রেবেকার স্বামী সুজাত সরদার। তিনি বলছিলেন, ‘আমার পোলা দুইডারে কে দেইখা রাখবে। আমি অহন অগোরে নিইয়া কী করব?’

গোয়ালন্দ ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের স্টেশনমাস্টার আবদুর রহমান বলেন, দুর্ঘটনার খবর পাওয়া মাত্র ঢাকা থেকে চারজন ডুবুরি এসে গতকাল রাত সাড়ে নয়টা পর্যন্ত অভিযান চালান। সন্ধ্যার দিকে একজনের লাশ পাওয়া যায়। পরবর্তী সময়ে বৈরী আবহাওয়ার কারণে অভিযান স্থগিত রাখা হয়। আজ সকালে আবার অভিযান শুরুর পর আরেক গৃহবধূর লাশ পাওয়া যায়।