অবৈধভাবে চলছে ৩৭% বাস-ট্রাক, করও দেয় না

সারা দেশে প্রায় ৩৭ শতাংশ বাস-ট্রাক অবৈধভাবে চলাচল করছে। সড়ক নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এসব যানবাহন ৫ থেকে ১০ বছর ধরে ফিটনেস (চলাচলের উপযোগী) সনদ নিচ্ছে না। আবার করও দিচ্ছে না। উল্টো জরিমানা মওকুফের জন্য দেনদরবার শুরু করেছেন মালিকেরা।

এই পরিস্থিতিতে সরকার শুধু রাজস্ববঞ্চিত হচ্ছে তা নয়, ফিটনেসবিহীন যানবাহনে দুর্ঘটনার ঝুঁকিও রয়েছে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সমিতির সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৮ সালে সর্বোচ্চ ২৯ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনার পেছনে ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান জড়িত। আর প্রায় ১৯ শতাংশ ঘটেছে বাস-মিনিবাসের কারণে। এসব যানবাহনের বড় অংশের ফিটনেস নেই। আবার পবিত্র ঈদে বেশির ভাগ লক্কড়ঝক্কড় বাস রং করে দূর পথে যাত্রী বহন করে। পথে এসব যানবাহন বিকল হয়ে যানজটের কারণ হয়ে ওঠে। আবার দুর্ঘটনার শিকারও হয়।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) সূত্র বলছে, ফিটনেস সনদ হালনাগাদ না থাকলে প্রতি মাসে ৪০০ টাকা করে জরিমানা হয়। ট্যাক্স-টোকেন সময়মতো না দিলে জরিমানাসহ বকেয়া দেড় গুণ হয়ে যায়। ফলে বছরে যানবাহনপ্রতি ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ বকেয়া জমে। বছর যত বাড়ে, জরিমানাসহ বকেয়ার পরিমাণও বাড়তে থাকে। এমনকি কোনো কোনো যানের বিপরীতে ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা পর্যন্ত বকেয়া জমে আছে। এসব যানবাহন পুলিশের হাতে ধরা পড়লে মামলা হয়। এই মামলা না মীমাংসা করে আবারও ধরা পড়লে পুনরায় মামলা দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে পুলিশকে টাকা দিয়ে এসব যানবাহন সড়কে চলে বলে অভিযোগ রয়েছে।

জানতে চাইলে বিআরটিএর চেয়ারম্যান মশিয়ার রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ১০ বছরের বেশি সময় যেসব যানবাহন সরকারি ফি ও জরিমানা না দিয়ে অবৈধভাবে চলছে, সেগুলোর নিবন্ধন বাতিল করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তিনি বলেন, কিছু বাস-ট্রাকের এত জরিমানা ও ফি জমে আছে, যেগুলো বিক্রি করলেও ওই পরিমাণ অর্থ হবে না। অতীতে জরিমানা মওকুফের সুযোগ দিলেও অনেকে নেয়নি।

গত বছরের জুলাইয়ে রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থীর প্রাণ গেলে সারা দেশে শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনে নামেন। গত মার্চে রাজধানীর নর্দ্দায় বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষার্থী আবরার আহমেদ চৌধুরী বাসচাপায় নিহত হওয়ার পর আন্দোলন শুরু করেন শিক্ষার্থীরা।এসব আন্দোলনের পর পুলিশ ও বিআরটিএ কিছুটা কঠোর হলে বিপাকে পড়েন মালিকেরা। এ জন্য জরিমানা মওকুফ করে কাগজপত্র হালনাগাদ করার দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছে মালিক সমিতি।

পরিবহন মালিক-শ্রমিক সূত্রগুলো বলছে, জরিমানা মওকুফ করার জন্য বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতি সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ে আবেদনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, মালিকদের আবেদনে এর আগে ২০১৬ ও ২০১৭ সালে দুই দফা জরিমানা মওকুফ করা হয়েছে। তবে অধিকাংশ মালিক এ সুবিধা নিয়ে কাগজপত্র হালনাগাদ করেননি। এখন বিআরটিএর ভ্রাম্যমাণ আদালত ও পুলিশের অভিযান জোরদারের কারণে হয়তো তাঁরা একই আবেদন করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

>

২০১৮ সালে প্রায় ২৯% সড়ক দুর্ঘটনার পেছনে ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান
প্রায় ১৯ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটেছে বাস-মিনিবাসের কারণে
দেশে ফিটনেসবিহীন ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান ৬৫ হাজার ৫৯৯টি
ফিটনেসবিহীন বাস-মিনিবাস ২৮ হাজার ৭৯৪টি

বিআরটিএ তথ্য বলছে, সারা দেশে বর্তমানে ফিটনেসবিহীন ট্রাক-কাভার্ড ভ্যানের সংখ্যা ৬৫ হাজার ৫৯৯। মোট ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান আছে ১ লাখ ৮০ হাজার ৩৪৫। অর্থাৎ, ৩৬ দশমিক ৩৭ শতাংশ ট্রাক-কাভার্ড ভ্যানের ফিটনেস সনদ নেই। অন্যদিকে বাস-মিনিবাস আছে ৭৬ হাজার ৪৯। এর মধ্যে ফিটনেস সনদ নেই ২৮ হাজার ৭৯৪টির (৩৭.৮৬ শতাংশ)। বিআরটিএর নথি অনুসারে, এই বাস-ট্রাকগুলোর বেশির ভাগই ২০০৯ সালের পর আর বিআরটিএতে আসেনি। বর্তমানে সব যানবাহন মিলে ফিটনেসবিহীন যানবাহনের সংখ্যা ৫ লাখ ১৮ হাজার ৪৫১। ২০০৯ সালে ফিটনেসবিহীন যানবাহনের সংখ্যা ছিল ৮৬ হাজার ২৭৪। ২০০৯ সালে নিবন্ধিত যানবাহন ছিল ১৩ লাখ ৭ হাজার ৩৮৬। বর্তমানে যানবাহন ৩৯ লাখ ৭৩ হাজার ২২৭।

সরকার ঢাকায় ট্রাক-কাভার্ড ভ্যানের বয়সসীমা নির্ধারণ করেছে ২৫ বছর। আর বাস-মিনিবাসের বয়সসীমা ২০ বছর। এরপর এসব যানবাহন ঢাকায় চলতে পারার কথা নয়। কিন্তু কাগজপত্র হালনাগাদ না থাকার কারণে এসব যানবাহন পুলিশকে ঘুষ দিয়ে চলে বলে অভিযোগ আছে। ঢাকার বাইরে যেসব যানবাহন বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর মালিকানা বদল করা যাচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে বেকায়দায় পড়েছেন মালিকেরা। গত ২৬ মে তেজগাঁওয়ে বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতি তাদের কার্যালয়ে এক জরুরি সভা করে। ওই সভায় দীর্ঘদিন কাগজপত্র হালনাগাদ নেই এমন যানবাহন জরিমানা ছাড়া ফিটনেস সনদ নবায়ন করার দাবি ওঠে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক রুস্তম আলী প্রথম আলোকে বলেন, ফিটনেসসহ অন্যান্য কাগজপত্র হালানাগাদ না থাকার পরও যানবাহন চলাচল বন্ধ নেই। এর জন্য মালিকদের হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে, ঘুষ দিতে হচ্ছে। সরকার জরিমানা মওকুফ করে দিলে বৈধ যে ফি ও কর আছে, তাও বিপুল। তখন টাকাটা সরকারের কোষাগারে জমা হবে। সময়মতো কেন ফি, কর দেওয়া হয় না জানতে চাইলে তিনি বলেন, যানবাহন চালাতে হলে ৫টি কাগজ হালনাগাদ থাকতে হয়। কোনো একটা সময়মতো নবায়ন না হলে অন্যগুলোও আর করা হয় না। একপর্যায়ে জরিমানাসহ কর-ফি এত বিপুল হয়ে যায়, তখন মালিকেরা ঘুষের পথ বেছে নেন। কিন্তু এখন পরিস্থিতি কিছুটা কঠিন। তাই সবাই বৈধ পথে যানবাহন চালাতে চাইছেন।

আইনে সব ধরনের যানবাহনে ফিটনেসসহ সব ধরনের কাগজপত্র হালনাগাদ থাকা বাধ্যতামূলক। নতুন যে সড়ক পরিবহন আইন হয়েছে তাতে কাগজপত্র না থাকার দায়ে জরিমানার পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে। নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর পাস করা হয় সড়ক পরিবহন আইন। এরপর আইনটির বেশ কয়েকটি ধারা সংশোধনের দাবিতে আন্দোলনে নামেন পরিবহন মালিক-শ্রমিকেরা। এতে আইনটি কার্যকরের বিষয়টি চাপা পড়ে যায়।

জানতে চাইলে পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সামছুল হক প্রথম আলোকে বলেন, বিআরটিএতে যানবাহনের কাগজপত্র হালনাগাদ করতে গিয়ে অনেকেই হয়রানির শিকার হন। দালালদের দৌরাত্ম্যের কারণে বাড়তি খরচও হয়। আবার মালিকেরা জানেন, কাগজপত্র হালনাগাদ না করেও চলা যায়। সব মিলিয়ে আইন প্রয়োগের ব্যবস্থা খুবই দুর্বল। এ জন্যই দিনের পর দিন এসব যানবাহন অবৈধভাবে চলছে। দুর্ঘটনা হলেই দেখা যায়, ওই গাড়ির ফিটনেস নেই, কাগজপত্র ভুয়া।