ঈদের ছুটিতে কুয়াকাটার হোটেলে যত ছাড়

কুয়াকাটার সিকদার রিসোর্ট অ্যান্ড ভিলার ভেতরে আছে এমন সুইমিং পুল। ছবি: নেছারউদ্দিন আহমেদ
কুয়াকাটার সিকদার রিসোর্ট অ্যান্ড ভিলার ভেতরে আছে এমন সুইমিং পুল। ছবি: নেছারউদ্দিন আহমেদ

ঈদের ছুটিতে পর্যটক টানতে ভাড়ায় ছাড় দিচ্ছে কুয়াকাটার হোটেলগুলো। পর্যটকদের জন্য আছে বিশেষ প্যাকেজ। এযাবৎ হোটেলগুলোয় বুকিং আশানুরূপ না। তারপরও সমুদ্রপাড়ের হোটেল ব্যবসায়ীরা হাল ছাড়েননি। আগামী দু-এক দিনের মধ্যে হোটেল-মোটেলে বুকিং বাড়তে পারে, এমনটাই তাঁরা মনে করছেন।

কুয়াকাটার অভিজাত হোটেল সিকদার রিসোর্ট অ্যান্ড ভিলাতে পর্যটকেরা শুধু থেকে নয়, ঘুরে বেড়িয়েও বিনোদন পাবেন। প্রায় ১৫ একর জমির ওপর গড়ে তোলা হয়েছে রিসোর্টটি। এর ভেতরের মেঠো পথ, বাগান, গাছগাছালির সমারোহে যে-কারও মন জুড়িয়ে যাবে। তা ছাড়া কটেজের ভেতরের বিশাল লেকে নৌকায় চড়ে ঘুরে বেড়ানোর মজাই আলাদা। টাওয়ার ভবনের উত্তর পাশের লনে বসে বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত আড্ডা দিতে পারবেন, সে রকম বসার ব্যবস্থা রয়েছে। তা ছাড়া ঢাকা থেকে ইচ্ছে করলে যে-কেউ হেলিকপ্টারে চড়েও এখানে অবতরণ করতে পারবেন। এ জন্য হেলিপ্যাড রয়েছে। নির্ধারিত ভাড়া দিয়ে রিসোর্টের নিজস্ব হেলিকপ্টার ব্যবহার করতে পারবেন। সবকিছু মিলিয়ে অন্য রকম এক ভালো লাগার জায়গা খুঁজে পাওয়া যাবে এখানটায়।

কুয়াকাটার হোটেল বনানী প্যালেসের সামনের অংশ। ছবি: নেছারউদ্দিন আহমেদ
কুয়াকাটার হোটেল বনানী প্যালেসের সামনের অংশ। ছবি: নেছারউদ্দিন আহমেদ

সিকদার রিসোর্ট অ্যান্ড ভিলার ব্যবস্থাপক (হিসাব) মো. শাহীন আলম জানান, তাঁদের রিসোর্টে ১২টি ভিলা, আর টাওয়ার ভবনে ৬৮টি কক্ষ রয়েছে। ভিলার ভাড়া ৩২, ২৮, ২৪ হাজার টাকা পর্যন্ত রয়েছে। ভিলার মধ্যে সুইমিং পুল, নিজেদের রান্না করে খাওয়ার ব্যবস্থা, সুপ্রশস্ত ডাইনিং, সুসজ্জিত ড্রেসিংরুম, বাথটাবসহ আধুনিক টয়লেট, লিভিংরুম রয়েছে। এ ছাড়া টাওয়ার ভবনের কক্ষগুলোর মধ্যে ডিলাক্স কক্ষ ১৪ হাজার টাকা, সুপিরিয়র কক্ষ ১২ হাজার টাকা এবং প্রিমিয়াম কক্ষের ভাড়া ১০ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। ভিলায় এবং টাওয়ার ভবনের কক্ষ ভাড়ার সঙ্গে যুক্ত হবে ১০ শতাংশ সার্ভিস চার্জ ও ১৫ শতাংশ ভ্যাট।

মো. শাহীন আলম বলেন, এবার ঈদ উপলক্ষে ভিলার ভাড়ায় ৫০ শতাংশ এবং আবাসিক কক্ষ ভাড়ায় ৪০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দেওয়া হয়েছে। তিনি আরও জানান, সিকদার রিসোর্টে যাঁরা অতিথি হয়ে আসেন, তাঁদের চলাফেরার জন্য পরিবহনসুবিধা তাঁরা দিয়ে থাকেন।

কুয়াকাটা গ্র্যান্ড হোটেল অ্যান্ড সি রিসোর্ট হচ্ছে কুয়াকাটার আরেকটি অভিজাত হোটেল। কুয়াকাটার জিরো পয়েন্ট থেকে অল্প পূর্ব দিকে বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধের পাশে সাত একর জমির ওপরে এ রিসোর্ট গড়ে তোলা হয়েছে। এখানকার বাহ্যিক পরিবেশও চমৎকার। সামনে রয়েছে বিশাল বাগান। হাঁটার পথ। বাগানে বসার বেঞ্চ। এর প্রতিটি কক্ষও সাজানো রয়েছে পরিপাটি করে। এ রিসোর্টের ফ্রন্টডেস্ক ইনচার্জ মো. সোহাগ হোসেন বলেন, ‘আমাদের হোটেলে ৪৮টি কক্ষ আছে। এর মধ্যে এক্সিকিউটিভ স্যুইটের ভাড়া ২৫ হাজার টাকা, ফ্যামিলি স্যুইটের ভাড়া ১৯ হাজার ২৪০ টাকা, সুপিরিয়র টুইন ডিলাক্স কক্ষের ভাড়া ১৪ হাজার ৫০০ টাকা, প্রিমিয়াম ডিলাক্স কক্ষের ভাড়া ১২ হাজার টাকা, ডিলাক্স কক্ষের ভাড়া ৯ হাজার ৫০০ টাকা এবং স্ট্যান্ডার্ড ডিলাক্স কক্ষের ভাড়া ৭ হাজার ৫০০ টাকা নির্ধারিত রয়েছে।

কুয়াকাটার সমুদ্রসৈকতে পর্যটকদের বসার জায়গা। ছবি: নেছারউদ্দিন আহমেদ
কুয়াকাটার সমুদ্রসৈকতে পর্যটকদের বসার জায়গা। ছবি: নেছারউদ্দিন আহমেদ

সোহাগ হোসেন বলেন, কেউ যদি দুই রাত তিন দিনের জন্য স্ট্যান্ডার্ড ডিলাক্স কক্ষ ভাড়া নেন, সে ক্ষেত্রে বিশেষ প্যাকেজ দেওয়া হবে। তবে তাঁদের এ অভিজাত হোটেলটিতেও অগ্রিম বুকিং কম হয়েছে বলে জানা গেল। বুকিং এত কম কেন? তা জানতে চাইলে এ কর্মকর্তা বলেন, প্রচণ্ড গরমে জনজীবন অতিষ্ঠ। এর মধ্যে দূর-দূরন্ত থেকে অনেকেই বাচ্চাদের নিয়ে আসতে ভয় পাচ্ছেন। তবে বুকিং কিছু হয়েছে। কিছু ঝুলন্ত অবস্থায় আছে। গতবারের চেয়ে এবার বুকিং কম বলে তিনি জানান। যাঁরা এ হোটেলে বোর্ডার হয়ে আসবেন, তাঁদের জন্য এখানেও প্রতিটি কক্ষ ভাড়ায় বিশেষ ছাড়ের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

ঈদের ছুটিতে কুয়াকাটায় এসে বেড়ানোর জন্য যেতে পারেন ‘ইলিশ পার্কে’। কুয়াকাটা পৌর শহরের ৩ নম্বর ওয়ার্ড এলাকায় এর অবস্থান। পার্কটিতে ঢুকলে ইলিশের বিশাল প্রতিকৃতি চোখে পড়বে। এটিই পার্কটির মূল বৈশিষ্ট্য। দূর থেকে দেখতে ইলিশের প্রতিকৃতি মনে হলেও মূলত এর মধ্যে রয়েছে একটি সুসজ্জিত রেস্তোরাঁ। এখানে একসঙ্গে ৫০ জন মানুষ বসে খেতে পারবেন। তা ছাড়া পার্কে বসে আড্ডা দেওয়ার জন্য গোলঘর, রাত্রিযাপনের জন্য সাতটি কক্ষ রয়েছে। পার্কের ডরমিটরিতে একসঙ্গে ২০ জনের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। এর ভাড়া পাঁচ হাজার টাকা। এ ছাড়া কাপল বেড দুই হাজার এবং ডাবল বেডের ভাড়া আড়াই হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। পার্কটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুম্মান ইমতিয়াজ তুষার বললেন, ‘আমরা অতিথিদের সাধ্যমতো সেবা দেওয়ার চেষ্টা করি। তাঁদের রুচিসম্মত খাবার, প্রয়োজনে সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করে বিনোদনের ব্যবস্থা করে থাকি।’

সিকদার রিসোর্ট অ্যান্ড ভিলার মধ্যে থাকা খালটি মন জুড়াবে। ছবি: নেছারউদ্দিন আহমেদ
সিকদার রিসোর্ট অ্যান্ড ভিলার মধ্যে থাকা খালটি মন জুড়াবে। ছবি: নেছারউদ্দিন আহমেদ

বিশেষ দিনে কুয়াকাটায় এসে লেম্বুরচর, স্বপ্নরাজ্য ইকো ট্যুরিজম, মিশ্রীপাড়া বৌদ্ধমন্দির, গঙ্গামিত সংরক্ষিত বন, ফাতরারচর বেড়াতে পারবেন। এসব জায়গায় যাতায়াতে মোটরসাইকেল, রিকশাভ্যান, ট্রলার, স্পিডবোটের ব্যবস্থা রয়েছে। জিরো পয়েন্টের কুয়াকাটা ট্যুরিস্ট সেন্টার এসব ক্ষেত্রে গাইড হিসেবে সহায়তা দিয়ে থাকে।

এ ছাড়া কুয়াকাটার হোটেল গ্রেভার ইন, হোটেল কুয়াকাটা ইন ইন্টারন্যাশনাল, হোটেল গ্রান্ড সাফা ইন্টারন্যাশনাল, হোটেল স্যান্ড বিচ, হোটেল সি কুইন, হোটেল নীলাঞ্জনা, হোটেল মোহনা, হোটেল বিচ হ্যাভেনসহ বাকি হোটেলগুলোতেও অগ্রিম বুকিং চলছে। তবে তা কম হয়েছে বলে জানা গেছে।

বিশেষ দিনগুলোয় দর্শনার্থীদের আগমনের কারণে খাবার হোটেল, চায়ের দোকান, শামুক-ঝিনুকের দোকানগুলোয় পর্যটক-দর্শনার্থীদের কাছ থেকে যাতে অতিরিক্ত মূল্য নিতে না পারে, সে ব্যাপারে কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় আগে থেকেই সংশ্লিষ্টদের সতর্ক করে দিয়েছেন। ভারপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) অনুপ দাশ বলেন, ‘আমরা হোটেল-মোটেলের মালিক ও খাবার হোটেলের মালিকদের ডেকে বলে দিয়েছি, পর্যটকদের কাছ থেকে কোনোভাবেই অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়া যাবে না। সে জন্য মূল্যতালিকা টাঙানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর ফলে আগত পর্যটকরাও মূল্যতালিকা দেখে হোটেলে থাকা এবং খাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারবেন। এরপরও কোনো ধরনের অনিয়মের খবর পাওয়া গেলে আমরা অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা নেব।’

একাধিক হোটেল মালিক জানান, পবিত্র রমজান মাসজুড়েই হোটেল ব্যবসায় মন্দা পরিস্থিতি বিরাজ করেছে। যার কারণে প্রতিটি হোটেলের মালিকপক্ষকে অন্য খাত থেকে টাকা জোগাড় করে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ঈদের আগে বেতন দিতে হয়েছে।

কুয়াকাটা হোটেল-মোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. শফিকুর রহমান চান বলেন, কুয়াকাটায় ছোট-বড় মিলিয়ে ৭০টির মতো হোটেল-মোটেল রয়েছে। এবারের ঈদকে সামনে রেখে পর্যটকদের সেবা দেওয়ার জন্য প্রতিটি হোটেলই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। হতাশার কথা হলো, এতগুলো হোটেলের মধ্যে মাত্র ১৫ শতাংশ বুকিং হয়েছে। তাঁর নিজের আবাসিক হোটেলটিতে এখন পর্যন্ত বুকিং হয়নি বলে জানালেন।

কুয়াকাটা গ্র্যান্ড হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টের প্রবেশদ্বার। ছবি: নেছারউদ্দিন আহমেদ
কুয়াকাটা গ্র্যান্ড হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টের প্রবেশদ্বার। ছবি: নেছারউদ্দিন আহমেদ

কুয়াকাটা শহরে নাগরিক সুবিধা বাড়ানোর নানা উদ্যোগের কথা জানালেন পৌরসভার মেয়র আবদুল বারেক মোল্লা। তিনি বললেন, কুয়াকাটা পৌরসভার উন্নয়নকাজ শুরু হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে কাঁচা সড়ক পাকা করা, বিদ্যুতায়নের ব্যবস্থা, ড্রেনেজ পাকাকরণ, বর্জ্য অপসারণ, সৌন্দর্যবর্ধন ইত্যাদি। এসব কাজ দৃশ্যমান হতে হয়তো কিছুটা সময় লাগবে। উন্নয়নকাজের অর্ধেকও সম্পন্ন করা গেলে কুয়াকাটা একটি আকর্ষণীয় ও বিনোদনের জায়গা হিসেবে গড়ে উঠবে।

স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ঈদ সামনে রেখে জিরো পয়েন্ট, বন বিভাগের জাতীয় উদ্যান, লেম্বুরচর, শুঁটকিপল্লি, মিশ্রীপাড়া বৌদ্ধমন্দির, রাখাইন মহিলা মার্কেটসহ আকর্ষণীয় সব পয়েন্টের নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। কুয়াকাটা পর্যটন পুলিশ, নৌ-পুলিশ এবং মহিপুর থানা-পুলিশ এ জন্য সমন্বিতভাবে কাজ করছে।

সিকদার রিসোর্ট অ্যান্ড ভিলার মহাব্যবস্থাপক ফয়সাল মাহমুদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘কুয়াকাটার অভ্যন্তরীণ সড়ক ব্যবস্থাপনা মোটেও ভালো হয়নি। তা ছাড়া পর্যটকেরা যে ঘুরে বেড়াবেন, সে রকম বিনোদনের ব্যবস্থা নেই। সৈকতটির অবস্থা খুবই খারাপ। এর জিরো পয়েন্টসহ বেশ কিছু এলাকা ভাঙনের কবলে পড়েছে। ভাঙাচোরা-শ্রীহীন কোনো কিছুই পর্যটকদের কাছে ভালো লাগেনি। এসব কারণেও অনেকে কুয়াকাটা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তাই আমরা মনে করি, কুয়াকাটাকে রক্ষার উদ্যোগ নেওয়া সবার আগে জরুরি। কুয়াকাটার প্রতি যত্নবান হলে, কুয়াকাটার সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা গেলে এমনিতেই কুয়াকাটায় পর্যটকের সংখ্যা বহুগুণ বেড়ে যাবে।’

কুয়াকাটা পর্যটন পুলিশের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) মো. জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘পর্যটকদের আগমনের কারণে কুয়াকাটা সৈকতসহ পার্শ্ববর্তী স্পটগুলোয় যাতে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে, সে জন্য আমরা পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। আমরা টহল পুলিশের সংখ্যাও বাড়িয়েছি। সৈকতে গোসল করতে নেমে কেউ যাতে বিপদে না পড়ে, সে জন্য ওয়াটার বাইকসহ পুলিশি টহল জোরদার করা হয়েছে।’