মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের সিদ্ধান্তে বিশেষজ্ঞদের সমর্থন

রোহিঙ্গা। প্রথম আলো ফাইল ছবি
রোহিঙ্গা। প্রথম আলো ফাইল ছবি

রোহিঙ্গাদের নির্যাতনের জবাবদিহি নিশ্চিত করার জন্য আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতে বাংলাদেশের মামলা দায়েরের নতুন উদ্যোগকে কূটনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা স্বাগত জানিয়েছেন। তবে তাঁরা সতর্ক করেছেন, এই প্রক্রিয়ায় যাওয়ার আগে চীন, ভারত ও রাশিয়ার মতো বন্ধুদেশগুলোর সঙ্গে অর্থবহ আলাপ-আলোচনা করে নেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।

গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে নারীপক্ষের আমন্ত্রণে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী তিন নারী বাংলাদেশ সফর করেন। তাঁরা হলেন নর্দান আয়ারল্যান্ডের ম্যারিড ম্যাগুয়ের, ইরানের শিরিন এবাদি ও ইয়েমেনের তাওয়াক্কল কারমান। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ওই তিন নোবেল কন্যা সাক্ষাৎ করেন। নোবেল বিজয়ীরা এ সময় বাংলাদেশের উদ্যোগে আইসিসিতে মামলা দায়েরে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন বলে একটি সূত্র জানায়। এ সময় তাঁরা যুক্তি দেন যে, মিয়ানমার আইসিসির পক্ষভুক্ত না হলেও বাংলাদেশ পক্ষভুক্ত। আর যেহেতু নির্যাতিত রোহিঙ্গারা পালিয়ে বাংলাদেশেই আশ্রয় নিয়েছে, তাই বাংলাদেশ আইসিসিতে যেতে পারে।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথমবারের মতো মিয়ানমারের জবাবদিহির বিষয়ে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতে মামলা দায়েরের সিদ্ধান্ত প্রকাশ করলেন। সৌদি আরবের মক্কায় ১৪তম ওআইসি সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১ জুন দেশটির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতে মামলা দায়েরে নির্দিষ্টভাবে স্বেচ্ছা তহবিল ও কারিগরি সহায়তা দিতে ওআইসি সদস্যদেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানান।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহযোগী চিন্তাশালা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) চেয়ারম্যান মুন্সি ফয়েজ আহমেদ গতকাল রোববার এক প্রশ্নের জবাবে প্রথম আলো-কে বলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রীর সর্বশেষ ঘোষণায় কোনো অবস্থানগত পরিবর্তন দেখি না। রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে বিদ্যমান দ্বিপক্ষীয় কার্যধারা চালুর পাশাপাশি বিষয়টিকে বহুপক্ষীয় ফোরামে নিয়ে যাওয়ার এটি একটি প্রয়াস। ওআইসিতে বক্তব্য দেওয়ার একটি সুযোগ প্রধানমন্ত্রী কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছেন।’

চীনে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত (২০০৭-১২) ফয়েজ আহমেদ অবশ্য বলেন, ‘আনুষ্ঠানিকভাবে মামলা দায়েরের বিষয়টি একটি নতুন দিক। তবে ওআইসি সংগঠনগতভাবে তেমন ভূমিকা রাখতে না পারলেও এর সদস্যভুক্ত অনেক দেশই আছে, যারা চাইলে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।’ তাঁর মতে, ওআইসি গোড়াতে রোহিঙ্গা ইস্যুতে কিছুটা সোচ্চার হলেও তারা পরে থেমে যায়। তিনি চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে অধিকতর আলোচনায় গুরুত্বারোপ করেন।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের (বিআইপিএসএস) প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অব.) এম মুনীরুজ্জামান অবশ্য সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফয়েজের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন। তিনি বলেন, ‘আইসিসিতে মামলা দায়েরের সিদ্ধান্ত নেওয়া স্পষ্টতই একটি পরিবর্তন। কারণ, এত দিন বাংলাদেশ আইসিসি প্রশ্নে তার অবস্থান স্পষ্ট করেনি। বাংলাদেশ এত দিন দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে যেসব প্রয়াস চালিয়ে আসছিল, তাতে আমরা অগ্রগতি দেখিনি। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের ফলে বাংলাদেশকে এখন রোহিঙ্গা সমস্যার বিষয়ে নতুন কৌশলগত আঙ্গিকে পুনর্বিবেচনা এবং পুনর্বিশ্লেষণ করে একটা সমাধানের ছক আঁকতে হবে।’ তিনি মনে করেন, ‘নিরাপত্তা পরিষদের সমর্থন ছাড়াই বাংলাদেশ আইসিসিতে মামলা দায়ের করতে পারে। কিন্তু সম্ভবত প্রতিকার চাওয়া যাবে অপরাধের। নাগরিকত্বের ফয়সালা বা রোহিঙ্গাদের আইনগত অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভবত আইসিসির এখতিয়ারে পড়বে না। তবে আইসিসিতে যাওয়ার পরে দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে সংকট নিরসনের পথ কতটা বাধাগ্রস্ত বা রুদ্ধ হবে, সেটা একটা বিবেচনার বিষয়। চীনের মতো বন্ধুদের মনোভাবটা বুঝে নিতে হবে। যাতে আইসিসিতে যাওয়ার পরে আমরা বড় ধরনের বিরোধিতার সম্মুখীন না হই।’

সাবেক পররাষ্ট্রসচিব তৌহিদ হোসেন অবশ্য প্রথম আলোকে বলেন, ‘আইসিসিতে গেলে ফলাফল যা–ই হোক, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে আমি স্বাগত জানাই। যদিও এটা ঠিক যে, আন্তর্জাতিক আদালতে গেলে অনেক সময় ফল পাওয়া যায় না। কিন্তু তেমন ঝুঁকি সত্ত্বেও বাংলাদেশকে আদালতে যেতে হবে। কারণ, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্যই আইসিসির সৃষ্টি হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘আমি সব সময় বলে এসেছি, দ্বিপক্ষীয় পর্যায়ে সুরাহা হবে না, তবে আমি মিথ্যা প্রমাণিত হলে খুশি হব। রয়টার্সের রিপোর্ট থেকে বিশ্ব জানল, তারা একটি স্থানের হত্যাকাণ্ডের দায়ে মাত্র সাতজন সৈন্যকে ১০ বছর করে জেল দিয়েছিল। কিন্তু এক বছর সাজা খাটার আগেই তাঁরা খালাস পেয়েছেন।’

তৌহিদ হোসেন অবশ্য এই বলে সতর্ক করেন যে, ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার ঘাটতি আমরা এর আগে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমে দেখেছি। যেমন প্রধানমন্ত্রী প্রথমবার জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে গিয়ে নিরাপত্তা ও অধিকারের সঙ্গে প্রত্যাবাসনে জোর দেন। পরে গিয়ে তার সঙ্গে ‘সেফ জোন’ প্রতিষ্ঠার কথা যুক্ত করেন। অথচ এরপর দেশটির সঙ্গে যখন চুক্তি হলো, তখন তাতে প্রধানমন্ত্রীর ওই নির্দেশনার প্রতিফলন ঘটল না। এবারের পর্বে যেন তেমন কিছুর পুনরাবৃত্তি না ঘটে।’

ওয়াশিংটনে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির মনে করেন, ওআইসিতে প্রধানমন্ত্রী মিয়ানমার সম্পর্কে শক্ত কথাই বলেছেন। তাঁর কথায়, মামলা করে কার্যকর ফল পেতে হলে নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্ত লাগবে। তাই বাংলাদেশকে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যরাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক তৎপরতা উন্নত করতে হবে। দরকারে শক্তি প্রয়োগের সিদ্ধান্ত ওখানেই হবে।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত অঙ্গীকার রয়েছে। দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে সমস্যা মেটাতে তিনি তাঁর সাধ্যের চেয়ে বেশি চেষ্টা করেছেন। অপেক্ষা করেছেন। কিন্তু প্রত্যাশিত ফল মেলেনি। তাই বিলম্বে হলেও আমরা এখন একটি বাস্তবসম্মত আইনি লড়াই প্রত্যক্ষ করব। এই সিদ্ধান্তকে যৌক্তিক মনে করি। তবে মিয়ানমার যেহেতু নিকটতম প্রতিবেশী, যদিও তারা মামলা দায়েরকে একটি ‘অ্যান্টাগনিস্টিক’ বা শত্রুভাবাপন্ন পদক্ষেপ হিসেবেই দেখবে, আর রোহিঙ্গাদের সে দেশে ফিরতে হবে, তাই তাদের সঙ্গে যথাসম্ভব কূটনৈতিক চ্যানেল খোলা রাখতে হবে।’

ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, ‘বাংলাদেশকে একটা সক্রিয় কূটনৈতিক প্রস্তুতি নিতে হবে। এর আশু লক্ষ্য থাকবে দুটি। প্রথমত, মিয়ানমারের ওপর চীন, ভারত ও রাশিয়ার যে প্রভাবটা আছে, সেটা বাংলাদেশ তার অনুকূলে কাজে লাগানোর সব চেষ্টাকেই সুদৃঢ় করতে হবে। ভারতে নরেন্দ্র মোদির নতুন সরকারকে এটা বলতে হবে যে, তাদের পক্ষে এর আগের মেয়াদে যতটা করা সম্ভব ছিল, সেটা তারা করেনি। দ্বিতীয়ত, দক্ষিণ-পূর্ব আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা আসিয়ানের একটি যৌথ শক্তি রয়েছে, তাকেও আহরণ করতে হবে। সম্ভব হলে এখান থেকেই উত্তম ফল আসবে।’

বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্কের বিশেষজ্ঞ মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রচলিত কূটনৈতিক প্রচেষ্টা উৎসাহব্যঞ্জক হয়নি বলেই প্রধানমন্ত্রী আইসিসিতে যাওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন। এর লক্ষ্য সংকট নিরসনে দেশটির কর্তৃপক্ষের ওপর চাপ সৃষ্টি করা। আমি আশা করব, এই পদক্ষেপ সত্ত্বেও মিয়ানমারের নির্বাচিত নেত্রী অং সান সু চি তাঁর প্রতি আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহমর্মিতা অনুভবে নিতে সক্ষম হবেন।’