নির্বিচারে কাটা হচ্ছে টিলা

শিবপুরের বাঘাব ইউনিয়নের টেকপাড়ার এই টিলার বেশির ভাগ অংশই কেটে ফেলা হয়েছে। সম্প্রতি তোলা  ছবি। প্রথম আলো
শিবপুরের বাঘাব ইউনিয়নের টেকপাড়ার এই টিলার বেশির ভাগ অংশই কেটে ফেলা হয়েছে। সম্প্রতি তোলা ছবি। প্রথম আলো

নরসিংদীর শিবপুরের বাঘাব ইউনিয়নের টেকপাড়ায় রাতের আঁধারে দুটি ব্যক্তিগত টিলা কাটা হচ্ছে। টিলার লাল মাটি বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন সিরামিক কারখানায়। পাঁচ মাস ধরে এভাবে টিলা কাটা হলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এর প্রতিকারে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

বাঘাব ইউনিয়নে টিলা আছে প্রায় ২৫০টি। পুরো উপজেলায় এর সংখ্যা হাজারের বেশি। বাঘাব, জয়নগর, চক্রধা ও যশোর—এই চারটি ইউনিয়নে ছোট-বড় এসব টিলার অবস্থান। এগুলোর অধিকাংশের উচ্চতা ২৫-৩৫ ফুটের মধ্যে। গত এক বছরে শুধু বাঘাব ইউনিয়নেই কাটা হয়েছে পাঁচটি টিলা।

স্থানীয় লোকজন বলছেন, খননযন্ত্রের (ভেকু) সাহায্যে সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত রাতের আঁধারে এসব টিলা কাটা হচ্ছে। বিভিন্ন সিরামিক কারখানার পাশাপাশি কিছু মাটি ব্যবহার করা হচ্ছে নিচু এলাকা ভরাটের কাজে। মাঝেমধ্যে পুলিশ আসে, টাকা নিয়ে ফিরে যায়। প্রশাসনের লোকজন এসব দেখেও দেখে না। প্রতি রাতে কমপক্ষে ১০টি ট্রাকে এসব লাল মাটি নেওয়া হয়।

জানা গেছে, কাঁচা টাকার লোভে স্থানীয় লোকজন নিজেদের ব্যক্তি মালিকানাধীন টিলা কাটতে শুরু করেছেন। একটা টিলায় হাজার হাজার ট্রাক লাল মাটি পাওয়া যায়। ভেকু ও ট্রাকভাড়া বাদে ট্রাকপ্রতি লাল মাটি বিক্রি হয় ৭০০-৮০০ টাকায়, আর ড্রাম ট্রাকপ্রতি ৩ হাজার ৫০০ টাকায়। টিলার মালিক পান ট্রাকপ্রতি ১০০০ টাকা, আর ড্রাম ট্রাকপ্রতি ৫০০ টাকা। একটি টিলা কাটা হলে পাশেরটিও ধসে পড়ার ঝুঁকিতে থাকে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, শিবপুর-বাঘাব আঞ্চলিক সড়কের টেকপাড়ায় সড়কঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে গত বছর কাটা একটি টিলার অর্ধেক অংশ। এর গা ঘেঁষা গলি ধরে ৫০ ফুট এগোলেই মোল্লা পরিবারের প্রায় ৩০ ফুট উচ্চতার ব্যক্তিগত টিলা, যার দুই-তৃতীয়াংশ এরই মধ্যে কাটা হয়েছে। টিলার মালিক খোকন মোল্লা। ভেকু দিয়ে মাটি কেটে বিক্রির দায়িত্ব পালন করছেন উপজেলার মাছিমপুর ইউনিয়ন যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রেজাউল কবির ওরফে রনি। খোকন মোল্লার বাড়িতে দুই দফা গিয়েও তাঁকে পাওয়া যায়নি। তাঁর পরিবারের সদস্যদের কাছে মুঠোফোন নম্বর চাওয়া হলেও তাঁরা দেননি।

এই টিলা কাটার তদারক করেন এমন একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘দুই মাস আগে থেকে এই টিলার লাল মাটি কাটা শুরু হয়েছে। তবে কয়েক দিন ধরে বৃষ্টির কারণে আপাতত বন্ধ আছে।’ কোথায় যাচ্ছে এই মাটি, জানতে চাইলে সুমন নামের এক ট্রাকচালক বলেন, নারায়ণগঞ্জের তারাব এলাকার চায়না–বাংলা সিরামিকে যাবে এই মাটি।

রেজাউল কবির বলেন, ‘টিলার মাটি কেটে বিক্রির ব্যবসা আমি করছি না, করেছে কাদির মিয়া নামের আমার এক পরিচিত জন।’

সরু গলির লাল মাটির সড়কে ট্রাকের চাকার দাগ ধরে ১০০ গজ এগিয়ে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় ১৫ বিঘা আয়তনের ২৫-৩০ ফুট উচ্চতার একটি টিলার বেশির ভাগ অংশই কেটে ফেলা হয়েছে। টিলার যে অংশ এখনো কাটা হয়নি, তাতে বর্তমানে ১৭টি ঘর আছে। টিলার ওপরে বসবাস করা মোক্তার ভূঁইয়া বলেন, ‘টেকের (টিলা) মধ্যে থাকা খুবই কষ্টের। বৃষ্টির দিনে কাদায় হাঁটা যায় না। তাই পুরা টিলা কেটে বাড়িঘর করব আমরা।’

একটি সূত্র বলছে, টিলাগুলোর এসব লাল মাটির অধিকাংশই বিক্রি বিভিন্ন সিরামিক কারখানায়। তবে এর সিংহভাগ বিক্রি হয় চায়না–বাংলা সিরামিকে। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সিরাজুল ইসলাম মোল্লা। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘শুনেছি মসজিদ করার জন্য টিলার মালিক সেটি কাটছেন। আমি তো শুধু মাটিটা কিনছি। আমি না কিনলেও অন্য কেউ কিনবেই। তবে আমার সিরামিক কারখানায় ব্যবহৃত লাল মাটি মালয়েশিয়া থেকে কিনে আনা হয়।’

পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মুহাম্মদ হাফিজুর রহমান বলেন, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী, সরকারি-বেসরকারি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন কাজে পাহাড়-টিলা কাটার কোনো সুযোগ নেই। এটি অবশ্যই দণ্ডনীয় অপরাধ। শিবপুর থানার ওসি মোল্লা আজিজুর রহমান বলেন, ‘টিলা কাটা সম্পর্কে স্থানীয় কেউ আমাদের কাছে কোনো অভিযোগ করেনি।’

ইউএনও হ‌ুমায়ুন কবীর বলেন, ‘কয়েক দিন আগে টিলার মাটি বহনের অপরাধে একজনকে সাত দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছি।’