ঈদের ছুটিতে হবিগঞ্জ, আছে পাহাড়-বন-বিলাসী রিসোর্ট

টিলা আর বনের মাঝে দ্য প্যালেস লাক্সারি রিসোর্ট। ছবি: সংগৃহীত
টিলা আর বনের মাঝে দ্য প্যালেস লাক্সারি রিসোর্ট। ছবি: সংগৃহীত

আগর, গর্জন, চাপালিশ, পাম, মেহগনি—হরেক রকমের গাছে ছাওয়া সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান। দু শর মতো জীবজন্তু আছে সেখানে। দেশের আরেক ঘন বন রেমা-কালেঙ্গা। বিরলপ্রায় মুখপোড়া হনুমানের দেখা মেলে এখানে। এমন বন, চা-বাগান দেখতে গেলে হবিগঞ্জে যেতেই হবে। নিসর্গের কাছে হারাতে গেলে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের এই জেলার জুড়ি নেই। আর জেলায় রয়েছে বিলাসবহুল রিসোর্ট দ্য প্যালেস লাক্সারি রিসোর্ট। সবুজ পাহাড়ের কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা দ্য প্যালেস ঈদকে ঘিরে আরও সরগরম হয়ে উঠেছে। এ ঈদে রিসোর্টের কোনো কক্ষই এখন ফাঁকা নেই।

সবুজের প্রশান্তি সাতছড়ি উদ্যান
হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে ঈদ উপলক্ষে দর্শনার্থীদের নানা রকম সুবিধা বৃদ্ধি করা হয়েছে। গহিন বনে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে দর্শনার্থীদের এ স্থানটি হতে পারে সবুজ প্রশান্তি।
সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানটি হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার রঘুনন্দন পাহাড়ে। হবিগঞ্জ জেলা সদর থেকে এর দূরত্ব ৪০ কিলোমিটার। ঢাকা থেকে সড়কপথে এর দূরত্ব ১৩০ কিলোমিটার। উদ্যানের কাছাকাছি নয়টি চা- বাগান আছে। উদ্যানের পশ্চিমে সাতছড়ি এবং পূর্ব দিকে চাকলাপুঞ্জি চা-বাগান অবস্থিত।

সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের প্রবেশ দ্বার। ছবি: হাফিজুর রহমান
সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের প্রবেশ দ্বার। ছবি: হাফিজুর রহমান

কী আছে সাতছড়িতে
সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের ভেতরে রয়েছে দুই শতাধিক প্রজাতির গাছপালা। সেগুন, আগর, গর্জন, চাপালিশ, পাম, মেহগনি, কৃষ্ণচূড়া, ডুমুর, জাম, জামরুল, সিধাজারুল, আওয়াল, মালেকাস, ইউক্যালিপটাস, আকাশমণি, বাঁশ, বেতসহ আছে নানা রকমের গাছগাছালি। এর ভেতরে আছে ১৯৭ প্রজাতির জীবজন্তু, যার প্রায় ২৪ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ১৮ প্রজাতির সরীসৃপ, ছয় প্রজাতির উভচর। আরও আছে প্রায় ১৫০-২০০ প্রজাতির পাখি। এটি বাংলাদেশের একটি সংরক্ষিত বনাঞ্চল এবং পাখিদের একটি অভয়াশ্রম বলা যায়। বনের ভেতর লজ্জাবতী বানর, উল্লুক, চশমাপরা হনুমান, কুলু বানর, মেছোবাঘ, মায়া হরিণ ইত্যাদি। সরীসৃপের মধ্যে সাপ। পাখির মধ্যে কাও ধনেশ, বনমোরগ, লালমাথা ট্রগন, কাঠঠোকরা, ময়না, ভিমরাজ, শ্যামা, ঝুটিপাঙ্গা, শালিক, হলদে পাখি, টিয়া প্রভৃতির আবাস রয়েছে।


শুধু যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ, তা নয়, সাতছড়িতে এ বছর দর্শনার্থীদের জন্য যুক্ত হয়েছে এক গাছ থেকে অন্য গাছে লাফিয়ে যাওয়ার জন্য ‘ট্রি অ্যাডভেঞ্চার’। অর্থাৎ এক গাছ থেকে অন্য গাছে যাওয়ার জন্য মইয়ের আদলে সংযোগপথ। এ ট্রি অ্যাডভেঞ্চারটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে সাতছড়িতে। এ ছাড়া পর্যবেক্ষণ টাওয়ার রয়েছে। এ টাওয়ার থেকে পুরো সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানকে উপভোগ করা যায়।
নাগরিক ব্যস্ততার পাশাপাশি একঘেয়েমি কাটিয়ে উঠতে এ স্থানটি অন্যতম হতে পারে সবার জন্যই। সবুজের আধার নান্দনিক সৌন্দর্যের এক লীলাভূমি সাতছড়ি উদ্যানটি। একটু বৃষ্টি হলে বনের সৌন্দর্য বেড়ে যায় বহুগুণ। বনের ভেতরে বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ আপনাকে দারুণভাবে শিহরণ জাগাবে।

বন বিভাগের পাশাপাশি ‘নিসর্গ’ নামের একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাও এ জাতীয় উদ্যানটির ব্যবস্থাপনার কাজে জড়িত। 'নিসর্গ সহায়তা প্রকল্পের অধীনে বন সংরক্ষণ ছাড়াও, বনে ইকো-ট্যুর পরিচালিত হয়। এ ছাড়া নিসর্গ প্রকল্পের অধীনে শৌখিন দ্রব্যাদির বিক্রি হয় সাতছড়িতে।
নিসর্গ প্রকল্পের সহসভাপতি আবুল কালাম বলেন, ‘ঈদ ঘিরে প্রতিবছর হাজারো মানুষের সমাগম ঘটে এ সাতছড়িতে। আমরা চাই বেশি বেশি দর্শনার্থী আসুক, প্রকৃতির সঙ্গে পরিচিত হোক। এ দর্শনার্থীদের মধ্যে অনেকেই পাখি দেখলে শিকার করতে চান। আবার কেউ কেউ ফুল ও ফলের গাছ থেকে আহরণ শুরু করেন, যা প্রকৃতির জন্য শুভ নয়।’ এ দুটি কাজ থেকে দর্শনার্থীদের বিরত থাকতে অনুরোধ করেন তিনি।
সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের বন কর্মকর্তা মাহমুদ হোসেন বলেন, নামমাত্র টাকা দিয়ে গহিন বন দর্শনের সুযোগ পাচ্ছেন হাজারো দর্শনার্থী। সকাল থেকে সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত যে কেউ এ বনে নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াতে পারেন। তাঁদের নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে পুলিশ টহল রাখা হয়েছে।

সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে ‘ট্রি অ্যাডভেঞ্চারে’ মাততে পারেন যে কেউ। এখানে এক গাছ থেকে আরেক গাছে যাওয়া যায়। ছবি: হাফিজুর রহমান
সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে ‘ট্রি অ্যাডভেঞ্চারে’ মাততে পারেন যে কেউ। এখানে এক গাছ থেকে আরেক গাছে যাওয়া যায়। ছবি: হাফিজুর রহমান

রেমা-কালেঙ্গা বনাঞ্চল ও বন্য প্রাণী অভয়ারণ্য
প্রায় ১ হাজার ৭৯৫ হেক্টর আয়তনের এ বনভূমিটি হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলায় অবস্থিত। ঢাকা থেকে এর দূরত্ব প্রায় ১৪০ কিলোমিটার।
বাংলাদেশ বন বিভাগের কালেঙ্গা রেঞ্জের চারটি বিট (কালেঙ্গা, রেমা, ছনবাড়ী আর রশিদপুর) নিয়ে রেমা-কালেঙ্গার বনাঞ্চল ও বন্য প্রাণী অভয়ারণ্য গঠিত। এখানে আছে বেশ কয়েকটি পাহাড়-টিলা।

রেমা-কালেঙ্গা বন্য প্রাণী অভয়াশ্রমে আছে ৩৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৭ প্রজাতির উভচর, ১৮ প্রজাতির সরীসৃপ, ১৬৭ প্রজাতির পাখি। এ ছাড়া ৬৩৮ প্রজাতির গাছপালা ও লতাগুল্মও আছে।
রেমা-কালেঙ্গার বনে পাঁচ প্রজাতির কাঠবিড়ালির মধ্যে বিরল প্রজাতির মালায়ন বড় কাঠবিড়ালির একমাত্র বসবাস এ বনেই। তিন প্রজাতির বানর কুলু, রেসাস আর লজ্জাবতীর দেখা মেলে এ অভয়ারণ্যে। এ ছাড়া আছে মুখপোড়া হনুমান, চশমাপরা হনুমান, উল্লুক, মায়া হরিণ, মেছোবাঘ, বন্য শূকর, গন্ধগোকুল, বেজি, শজারু ইত্যাদি। বনের ১৮ প্রজাতির সরীসৃপের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কোবরা, দুধরাজ, দাঁড়াস, লাউডগা ইত্যাদি।
রেমা-কালেঙ্গা বন্য প্রাণী অভয়াশ্রমে আছে প্রায় ১৬৭ প্রজাতির পাখি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ভীমরাজ, টিয়া, হিল ময়না, লাল মাথা কুচকুচি, সিপাহি বুলবুল, বসন্তবৌরি, শকুন, মথুরা, বনমোরগ, প্যাঁচা, মাছরাঙা, ইগল, চিল ইত্যাদি।
রেমা-কালেঙ্গা বন্য প্রাণী অভয়াশ্রমে আছে তিনটি ট্রেইল বা পথ। প্রতিটি ছবির মতো সুন্দর দেখতে। অভয়ারণ্যের ভেতরে আছে সুউচ্চ একটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার। টাওয়ারের মাথাটি বনের উঁচু উঁচু গাছগুলোর মাথা ভেদ করে আকাশে উঁকি মেরেছে। সেখানে দাঁড়িয়ে দেখা যায় রেমা-কালেঙ্গার প্রাকৃতিক লীলাভূমি। এ টাওয়ারের নিচেই আছে আঁকাবাঁকা একটি লেক।

কীভাবে যাবেন
রেমা-কালেঙ্গা অভয়ারণ্যে দুভাবে যাওয়া যায়। ঢাকা থেকে সিলেটগামী বাস কিংবা ট্রেনে চড়ে আপনাকে শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলায় আসতে হবে। এখান থেকে অটোরিকশা করে যাওয়া যায় রেমা-কালেঙ্গা। বাসে শায়েস্তাগঞ্জের ভাড়া প্রায় ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। এ ছাড়া ঢাকা-সিলেটগামী আন্তনগর যে কোনো ট্রেনে চড়ে আপনাকে শায়েস্তাগঞ্জ জংশনে নেমে রেমা-কালেঙ্গায় যেতে হবে। আবার শায়েস্তাগঞ্জ থেকে কালেঙ্গার বেবিট্যাক্সি ভাড়া ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা।
রেমা- কালেঙ্গার দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ বন বিভাগের হবিগঞ্জ কার্যালয়ের সহকারী বন কর্মকর্তা (এসিএফ) আবদুল্লাহ আল মামুন জানান, এ বনাঞ্চলটি সবার জন্য উন্মুক্ত। এতে প্রবেশ করতে আলাদা কোনো প্রবেশ মূল্য দিতে হয় না। রেমা-কালেঙ্গায় থাকার জন্য তাঁদের নিজস্ব রেস্ট হাউস থাকলেও তা সংরক্ষিত। তবে ব্যক্তিমালিকানায় বেশ কটি রিসোর্ট আছে। সেখানে ভাড়া নিয়ে থাকার সুবিধা রয়েছে।

দ্য প্যালেস রিসোর্টের সম্মুখ ভাগ। ছবি
দ্য প্যালেস রিসোর্টের সম্মুখ ভাগ। ছবি

দ্য প্যালেস লাক্সারি রিসোর্ট
হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার পুটিজুড়ি এলাকায় অবস্থিত দ্য প্যালেস রিসোর্ট। বাহুবলের সবুজ টিলার চূড়ায় চূড়ায় গড়ে তোলা এ প্যালেসটি দেখলে মোগল আমলের রাজপ্রাসাদই মনে হবে আপনার কাছে। এক টিলা থেকে অন্য টিলায় যাতায়াতের জন্য তৈরি করা হয়েছে দুটো ঝুলন্ত সেতু। পাশে রয়েছে থরে থরে ফল আর সবজির বাগান। রিসোর্ট থেকে এক পা এগোলেই চোখে পড়বে সবুজ চা-বাগান। এ প্রকৃতির সজীবতা উপভোগ করতেই এখানে ছুটে আসছেন নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ।
এ রিসোর্টের একেবারে ন্যূনতম ভাড়া ১১ হাজার ৫০০ টাকা। আর তিন কক্ষের প্রেসিডেনশিয়াল ভিলার ভাড়া এক দিনে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা! তাতেও কমতি নেই ভাড়া নেওয়া লোকের।
হবিগঞ্জের দ্য প্যালেস লাক্সারি রিসোর্টে প্যালেস সূত্রে জানা গেছে, তাদের অধিকাংশ রিসোর্ট কক্ষ ও ভিলা ভাড়া হয়ে গেছে। টানা সরকারি ছুটিতে হঠাৎ করে অতিথির সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। তবে কর্তৃপক্ষ নতুন করে ভাড়া বাড়ায়নি। ছুটিতে আসা অতিথিদের জন্য সকালের নাশতা, দুপুর ও রাতের খাবারে বিশেষ অফার রাখা হয়েছে।

সাতছড়ির বনের হনুমান। ছবি: হাফিজুর রহমান
সাতছড়ির বনের হনুমান। ছবি: হাফিজুর রহমান

ঈদকে ঘিরে প্যালেস কর্তৃপক্ষ ওয়াটার জোন তৈরি করেছে। লেকে ছাড়া হয়েছে চীন থেকে আনা বেশ কিছু নৌকা। তা ছাড়া ছোট-বড় সবার সময় কাটানোর জন্য রয়েছে নানা রকম গেম।

এ ছাড় এর ভেতরে আছে বিলিয়ার্ড, রিমোট কন্ট্রোল কার রেসিং, ফুটবল, বাস্কেটবল আর টেনিস গ্রাউন্ড। আছে দুটো সিনেপ্লেক্সে থ্রি-ডি সিনেমা দেখার ব্যবস্থা। দোতলায় বার কাম রেস্তোরাঁ। রিসোর্টের ভেতরে চলাচলে আছে গলফ কোর্ট। যত ইচ্ছা সিনেমা দেখেন, কার্টে করে ঘুরে বেড়ান আর ইনফিনিটি পুলে সাঁতরে বেড়ান না কেন, এ জন্য আপনাকে বাড়তি টাকা গুনতে হবে না।

দ্য প্যালেস লাক্সারি রিসোর্টের জেনারেল ম্যানেজার জোসেফ লিটন গোমেজ প্রথম আলোকে বলেন, ঈদকে ঘিরে তাঁরা কিছু সুবিধা বৃদ্ধি করেছেন। তবে ভাড়া বাড়াননি। আনন্দ দেওয়ার জন্য ছোট-বড় সবাইকে সমানভাবে গুরুত্ব দিয়ে গেম জোনের সংখ্যা বাড়িয়েছেন। বিশেষ করে এবার লেকে নৌকা ছাড়ায় সবার আকর্ষণ সেই দিকে।

লিটন গোমেজ জানান, চাহিদা অনুযায়ী তাঁরা সব ধরনের ব্যবস্থা রেখেছেন। তাঁদের এ লাক্সারি রিসোর্টে বিভিন্ন ধরনের কক্ষ আছে। টাওয়ারে এক্সিকিউটিভ রুমের ভাড়া ভ্যাট ছাড়া ১১ হাজার ৫০০ টাকা থেকে শুরু। এক শয্যার রুমের ভিলাগুলো ১৮ হাজার ৫০০ টাকা। দুই শয্যা ভিলা ৩১ হাজার ৫০০ টাকা এবং তিন শয্যার ৪১ হাজার ৫০০ টাকা। আছে তিন কক্ষের প্রেসিডেনশিয়াল ভিলা রবি শঙ্কর ও জর্জ হ্যারিসন। ভ্যাট ছাড়াই এগুলোর জন্য দিনপ্রতি ভাড়া গুনতে হবে ১ লাখ ২০ হাজার টাকার মতো।