সমাজের 'ভয়ে' ঈদেও বাড়ি ফেরা হয় না তাসনুভার

ছয় বছরের বেশি সময় ধরে ঈদে বাড়ি যাওয়া হয় না। বাড়ি গেলে পরিবার ছাড়াও পাড়াপড়শি বা অন্যরা কী বলবে? এইবারই প্রথম, মা একবারও বলেননি, ‘বাড়ি আসবি না?’ কিন্তু মা ছাড়া, মায়ের হাতের বানানো শরবত ছাড়া তো ঈদ হয় না। তাই ঈদ মানেই মন খারাপের পাল্লা ভারী হওয়া। ঈদ মানেই মনের কষ্টগুলোকে আবার নতুন করে মনে করা।

কথাগুলো বলছিলেন রূপান্তরিত নারী (ট্রান্সজেন্ডার) তাসনুভা আনান শিশির। তাঁর অপরাধ শৈশবের কামাল হোসেন শিশির থেকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নিজেকে তাসনুভা আনানে রূপান্তরিত করেছেন। পরিবার, সমাজ কেউ তো তা মানতে পারছে না।

প্রথম আলো কার্যালয়ে বসে তাসনুভা বলছিলেন তাঁর কথা। বললেন, হরমোন থেরাপি, মানসিক থেরাপিসহ বিভিন্ন ধাপ পার হয়ে কলকাতায় গিয়ে তিনি অস্ত্রোপচার করেছেন সাত বছর আগে। লোকে বলবে ‘অমুকের ছেলে হিজড়া’—কথাটি মানতে পারেননি তাসনুভার বাবা। ফলে, পরিবার থেকেই বিচ্ছিন্ন হতে হয়।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক লাইভের এক অনুষ্ঠানে তাসনুভাকে দেখে লোকজন নানান কথা বলেন, এসব কথা সহ্য করতে পারেননি বাবা। তিনি স্ট্রোক করেন। তাই সরাসরি বাবার সামনে গেলে কী অবস্থা হবে ভেবে আর বাড়ি যাওয়া হয় না। তাসনুভা বলেন, ‘ঈদে প্রতিবার ভাবি বাড়ি যাব। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সাহস পাই না। মনে হয়, আমার একার জন্য সবাইকে অশান্তিতে রেখে লাভ নেই।’

তাসনুভা ফেসবুকে লিখেছেন, ‘হারিয়ে যাইনি—এই তো জরুরি খবর’। আরেক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘ফিরব ঘরে কোথায় এমন ঘর, ঘুম আসে না ঘুম স্বার্থপর’।

তাসনুভা জানালেন, চার বোন, দুই ভাই (তাঁকেসহ) মিলে ছোটবেলাটা ভালোই কেটেছে। তবে কিশোর বয়স থেকেই শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনগুলো বুঝতে শুরু করেন। বাবা-মাও বিষয়টি জানতে পারেন, কিন্তু মানতে বা বুঝতে চাননি। চার বোনের বিয়ে হয়েছে। এক ভাই বিয়ে করে আলাদা সংসার পেতেছেন। বাড়িতে বাবা-মা একা থাকেন।

তাসনুভা বলেন, ‘বাবা আর্থিকভাবে যত দিন সক্ষম ছিলেন, তত দিন রাগটাও বেশি ছিল। তবে এখন বাবা আর্থিকভাবে আমার ওপর নির্ভরশীল। তাই আস্তে আস্তে বলা শুরু করেছেন, তুমি ভালো থাকলেই হলো। কিন্তু পাড়াপড়শির চিন্তা তো আছেই। মায়ের সঙ্গে ফোনে কথা হয়। অনেক দিন আগে ভিডিও কলে মায়ের মুখটা একটু দেখেছি। জানি, মা আমার জন্য প্রতিদিনই মন খারাপ করেন।’

তাসনুভা আনান শিশির। ছবি: দীপু মালাকার
তাসনুভা আনান শিশির। ছবি: দীপু মালাকার

তাসনুভার বাড়ি বাগেরহাট। ২০১৪ সাল থেকে তিনি ঢাকায় থাকা শুরু করেন। বর্তমানে ট্রান্সজেন্ডার, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে কর্মরত বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি নামক একটি এনজিওতে প্রকল্প কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করছেন তাসনুভা। এর আগে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনেও কাজ করেছেন তিনি।

ঈদ সম্পর্কে জানতে চাইলে বললেন, এখন আর ঈদের দিন বিশেষ কোনো দিন বলে মনে হয় না। তবে এ কথা বললেও স্মৃতিতে চলে গেলেন ছেলেবেলায়। জানালেন, তাঁর মায়ের হাতের বরিশালের একটি আঞ্চলিক শরবত (চালের গুঁড়া, আদা, মুড়ি, আখের গুড়সহ বিভিন্ন উপাদানে তৈরি) দিয়ে ঈদের দিন শুরু হতো। এখনো সেই শরবতের জন্য মন কেমন করে। তারপর বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে বের হতেন, সেসব দিনের কথা খুব মনে পড়ে। নদীর পাড়ের বাড়িটাও খুব টানে।

তাসনুভা সমাজকর্ম বিষয়ে এমএ করেছেন। ২০০৬ সাল থেকে থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত। বর্তমানে বটতলা থিয়েটার দলের সদস্য। এ ছাড়া ছোটবেলা থেকেই নাচতেন তাসনুভা।

তাসনুভা ঢাকায় একাই থাকেন। ঈদের দিন নিয়ে বিশেষ কোনো পরিকল্পনা নেই। ঈদের শপিং বলেও কিছু নেই তাঁর জীবনে। বললেন, ‘আগে ঈদে মায়ের জন্য শাড়ি কিনতাম। অন্যদের জন্য কিনতাম। এখন টাকা পাঠিয়ে দিই। এখন আর মায়ের জন্য কিছু কেনা হয় না, তাই নিজের জন্যও কিনি না। এখন মা ঈদে কী পরেন তাও জানি না। কেমন দেখতে লাগে কে জানে। সব মিলে ঈদ এলে অস্থির লাগতে থাকে। এই দিনটাতে খুব বিরক্ত হই।’

তাসনুভা বললেন, ‘মা ছাড়া ঈদ করতে ভালো লাগে না। আমাদের নিয়ে সমাজের মনোভাব যত দিন না পাল্টাবে, তত দিন মায়ের সঙ্গে ঈদ করা হবে না। বর্তমান সরকার বেশ খানিকটা এগিয়ে এসেছে। সমাজের মনোভাব পাল্টাতে গণমাধ্যমকেও এগিয়ে আসতে হবে। এখন পর্যন্ত হিজড়া, ট্রান্সজেন্ডারদের মিডিয়াতে বাজেভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে, এটা বন্ধ করতে হবে।’