শোলাকিয়ায় বৃষ্টির মধ্যেও লাখো মুসল্লির ঢল

বৃষ্টি উপেক্ষা করে শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠে লাখো মুসল্লির ঢল। ছবি: প্রথম আলো
বৃষ্টি উপেক্ষা করে শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠে লাখো মুসল্লির ঢল। ছবি: প্রথম আলো

কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় প্রতিবারের মতো এবারও দেশের সবচেয়ে বড় ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়েছে। এবার দেশের বৃহত্তম এ ঈদগাহ মাঠে বৃষ্টি উপেক্ষা করে লাখো মুসল্লির সমাগম হয়েছে। এবার ঈদের দিন ভোর থেকেই কিশোরগঞ্জে থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। জামাত শুরু করার প্রায় দেড় ঘণ্টা আগে পৌনে ৯টা থেকে অঝোর ধারায় বৃষ্টি শুরু হয়। এরপরও থেমে থাকেনি মুসল্লির ঢল।

লাখো মুসল্লি শহরের আশপাশ ও দূর-দূরান্ত থেকে ছাতা আর পলিথিন মাথায় দিয়ে আবার অনেকে ভিজে ঈদগাহ মাঠে এসে জড়ো হন। তবে প্রতিবছরের মতো জামাত ঠিক সকাল ১০টায় শুরু হওয়ার কথা থাকলেও বৈরী আবহাওয়ার কারণে সকাল ১০টা ২৪ মিনিটে শুরু করতে হয়। মাঠে অবস্থানরত লাখো মুসল্লি বৃষ্টিতে ভিজে কাদামাখা অবস্থায় অস্বস্তিতে পড়ে জামাত শুরুর জন্য কর্তৃপক্ষকে বারবার তাগাদা দেন।

এবার অনুষ্ঠিত হলো ঈদুল ফিতরের ১৯২তম জামাত। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা মুসল্লিদের এই জামাতে ইমামতি করেন ইসলাহুল মুসলিমিন পরিষদের চেয়ারম্যান মাওলানা ফরিদ উদ্দীন মাসউদ। নামাজ শেষে বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর শান্তি কামনা করে মোনাজাত করা হয়।

দেশের সবচেয়ে বড় এই ঈদের জামাত নির্বিঘ্ন করতে ব্যাপক নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়েছিল স্থানীয় প্রশাসন। মোতায়েন করা হয়েছিল র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব), আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন), রেঞ্জ রিজার্ভ ফোর্স (আরআরএফ), বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এবং জেলা পুলিশের সহস্রাধিক সদস্য। মাঠের ভেতর ও বাইরে ছিল ৬৪ সিসি ক্যামেরা, পুরো মাঠ পর্যবেক্ষণের জন্য তিনটি ড্রোন। ছয়টি পর্যবেক্ষণ টাওয়ারের মাধ্যমে আগত ব্যক্তিদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হয়। মাঠের ভেতর-বাইরে পুলিশ বাহিনীকে সহায়তায় ছিল বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবক দল। নিরাপত্তার স্বার্থে কোনো ধরনের ব্যাগ নিয়ে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। শুধু পাতলা জায়নামাজ নিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে নামাজ আদায় করেন মুসল্লিরা।

শোলাকিয়া মাঠের নিরাপত্তার জন্য দক্ষিণে তিনটি, পূর্বে তিনটি এবং উত্তর পাশে একটি প্রবেশপথ খোলা রাখা হয়। এর মধ্যে ছয়টি প্রবেশপথে আর্চওয়ে বসানো হয়। একটি পথ গাড়ি প্রবেশের জন্য রাখা হয়েছিল। শোলাকিয়ায় ঈদের জামাত আদায়ে বিভিন্ন জেলার মুসল্লিদের যাতায়াতে দুটি বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠে নামাজ আদায় করতে আসেন মুসল্লিরা। ছবি: প্রথম আলো
দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠে নামাজ আদায় করতে আসেন মুসল্লিরা। ছবি: প্রথম আলো

নামাজ শেষে দেওয়ানগঞ্জ থেকে আসা মকবুল হোসেন (৭০), নরসিংদী থেকে আসা আবুবক্কর (৬৫) বলেন, নামাজ আদায়ে তাঁরা এক দিন আগেই এসেছেন। মাঠের পূর্ব পাশে কুমুদিনী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তাঁরা রাত্রিযাপন করেন। সকালে মাঠে এসে ভিজে নামাজ আদায় করেন। শান্তিতে ঈদ জামাত অনুষ্ঠিত হওয়ায় তাঁরা স্বস্তি প্রকাশ করলেও বৃষ্টির মধ্যে লাখো মুসল্লিকে কষ্ট দিয়ে নামাজ দেরিতে শুরু করায় তাঁরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তাঁরা জানান, প্রায় ১০ থেকে ১৫ বছর ধরে তাঁরা এ মাঠে নিয়মিত নামাজ আদায় করেন। আরও বৃষ্টি উপেক্ষা করে নামাজ আদায় করেছেন। কিন্তু কখনো নামাজ আদায়ে এ রকম দেরি হয়নি।

শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠ কমিটির সভাপতি ও কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো.সারওয়ার মুর্শেদ চৌধুরী বলেন, এবার আবহাওয়া অনুকূলে না থাকলেও লাখো মুসল্লির ঢল নেমেছিল শোলাকিয়ায়। ২০১৬ সালে শোলাকিয়ায় ঈদের জামাতের সময় জঙ্গি হামলার বিষয়টি মাথায় রেখে এবার মাঠে বাড়তি নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল।

২০১৬ সালের ৭ জুলাই ঈদের দিন শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠের কাছে পুলিশ সদস্যদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালায় জঙ্গিরা। এতে পুলিশের দুই সদস্য, স্থানীয় এক নারী, সন্দেহভাজন জঙ্গিসহ চারজন নিহত হন।

নির্বিঘ্নে নামাজ আদায় করে মুসল্লিরা ঘরে ফেরায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপার (এসপি) মো. মাশরুকুর রহমান খালেদ। এর আগে মাঠের ঐতিহ্য ও রেওয়াজ অনুযায়ী বন্দুকের ফাঁকা গুলির মাধ্যমে নামাজ শুরু হয়।

মসনদ-ই-আলা ঈশা খাঁর ষষ্ঠ বংশধর দেওয়ান মান্নান দাদ খান ১৮২৮ সালে জেলা শহরের পূর্ব পাশে নরসুন্দা নদীর তীরে প্রায় সাত একর জমির ওপর এই ঈদগাহ প্রতিষ্ঠা করেন। জনশ্রুতি রয়েছে, এই মাঠে প্রথম অনুষ্ঠিত জামাতে সোয়া লাখ মুসল্লি অংশ নেন। এ কারণে এর নাম হয় সোয়া লাখ। পরে উচ্চারণ পরিবর্তন হতে হতে শোলাকিয়া মাঠ নামে এর পরিচিতি হয়। প্রতিবছর চার লাখের বেশি মুসল্লি মাঠ ও এর আশপাশের রাস্তাঘাট, বাড়ির ছাদ এবং উঠানে নামাজ আদায় করেন।