রাতারাতি ধ্বংসস্তূপ চকবাজারের 'জাহাজ বাড়ি'

ভেঙে ফেলা হয়েছে পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ভবন ‘জাহাজ বাড়ি’। স্থানীয় লোকজন জানান, ঈদের রাতে ভাঙা হয়  প্রত্নতাত্ত্বিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভবনটি। চকবাজার, ৭ জুন। ছবি: দীপু মালাকার
ভেঙে ফেলা হয়েছে পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ভবন ‘জাহাজ বাড়ি’। স্থানীয় লোকজন জানান, ঈদের রাতে ভাঙা হয় প্রত্নতাত্ত্বিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভবনটি। চকবাজার, ৭ জুন। ছবি: দীপু মালাকার

হাই কোর্টের নির্দেশ অমান্য করে ঈদের দিন রাতে কে বা কারা গুঁড়িয়ে দিয়েছে পুরান ঢাকার চকবাজারের ‘জাহাজ বাড়ি’। ভবন নয়, সেখানে এখন শুধু ইট-পাথরের স্তূপ।

ভবন ভাঙার খবর পেয়ে পুলিশ গিয়ে তা বন্ধ করে দেয় বলে চকবাজার থানার ওসি শামীম আল রশীদ জানান। তাঁর দাবি, ‘আমি যতটুকু শুনেছি অনেক পুরোনো ঐতিহ্যবাহী দোতলা এই ভবনটি হাজি সেলিম কিনে নিয়েছেন। তিনি এটি ভেঙে নতুন কিছু করবেন হয়তো। কিন্তু প্রত্নতাত্ত্বিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় ব্যবসায়ী ও স্থানীয়দের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হওয়ায় ভাঙার কাজ বন্ধ রাখা হয়েছে। থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে। যেহেতু এটি জায়গা-জমির ব্যাপার, তাই এটি আদালতেই ফয়সালা হবে।’

স্থানীয় লোকজন বলছেন, তাঁদের এলাকার সাংসদ ও আওয়ামী লীগের নেতা হাজি সেলিমের লোকজন ঈদের দিন বুধবার রাতে হঠাৎ চকবাজারের এই ভবন ভেঙে ফেলেন। তবে এ ব্যাপারে হাজি সেলিমের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

ঘটনার পর বৃহস্পতিবার চকবাজার থানায় একটি জিডি করেছেন বলে জানান ঢাকার হেরিটেজ সংরক্ষণের দাবিতে আন্দোলনরত সংগঠন আরবান স্টাডি গ্রুপের প্রধান নির্বাহী তাইমুর ইসলাম। তিনি জানান, আরবান স্টাডি গ্রুপের পক্ষ থেকে করা এক রিট আবেদনে হাই কোর্ট ২০১৭ সালে পুরান ঢাকার ২২০০ ঐতিহ্যবাহী ভবন ও স্থাপনার ধ্বংস, পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন।
তাইমুর বলেন, ‘হাই কোর্টের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে শতবর্ষী ঐতিহ্যবাহী ভবনটি গত মার্চ মাস থেকে ভাঙার চেষ্টা চলছিল। তখন জিডি করে থানার সাহায্যে ভাঙা বন্ধ করা হয়। এবার এমন একটা সময়ে এমনভাবে করা হলো, যেন বাধা দেওয়ার কোনো সুযোগ না থাকে। ঈদের ছুটিতে গোপনে কাজটি করা হয়েছে। সর্বশেষ জিডি করার পর গতকাল রাতেও ভাঙা হয়েছে।

তিনি জানান, গত সাত-আট মাসে আরবান স্টাডি গ্রুপের সদস্য ও স্বেচ্ছাসেবকদের প্রচেষ্টায় কিছু ভবন ভাঙার চেষ্টা ঠেকানো গেলেও ইতিমধ্যে পুরান ঢাকার বেশ কয়েকটি ঐতিহ্যবাহী ভবন ভাঙা হয়েছে। সে তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন এ বাড়ি।

প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ‘জাহাজ বাড়ি’ ভাঙার ঘটনায় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগকে ‘দখল লীগ’ বলে আখ্যা দিয়েছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। শুক্রবার দুপুরে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ আখ্যা দেন। রিজভী বলেন, ‘স্থানীয় সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতা হাজি সেলিমের লোকজন দিয়ে ঈদের রাতে হঠাৎ চকবাজারের জাহাজ বাড়ি ভেঙে ফেলা হয়েছে। এই বাড়িটি একটি হেরিটেজ। শতবর্ষী এই ঐতিহ্যবাহী ভবনটি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। হাই কোর্টেরও নিষেধাজ্ঞা ছিল না-ভাঙার ব্যাপারে। তার পরও আওয়ামী দখলদারির হাত থেকে ঐতিহ্যবাহী বাড়িটি রেহাই পেল না। এই ঘটনায় আবারও প্রমাণ হলো, আওয়ামী লীগ মূলত এখন “দখল লীগ”-এ পরিণত হয়েছে।’

জানা গেছে, উনিশ শতকের মাঝামাঝিতে নির্মিত এই ভবনই ঢাকার প্রথম বাণিজ্যিক ভবন হিসেবে বিবেচিত হতো। ওই ভবনের বিভিন্ন দোকানের ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভবনটি ওয়াকফ এস্টেট হিসেবে ছিল। তারা নিয়মিত ওয়াকফ প্রশাসকের কার্যালয়ের প্রতিনিধিকে ভাড়া দিয়ে আসছিলেন। ‘হক সাহেব’ নামে পরিচিত ওয়াকফের ওই প্রতিনিধি ওমরা করতে সৌদি আরব গেছেন বলে ব্যবসায়ী আফতাব উদ্দিন জানান।

‘জাহাজ বাড়ি’র পুরোনো ছবি
‘জাহাজ বাড়ি’র পুরোনো ছবি

আরবান স্টাডি গ্রুপ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালের ১৩ আগস্ট আরবান স্টাডি গ্রুপের (ইউএসজি) করা এক রিট আবেদনের রায়ে ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ২২০০ ভবন না ভাঙতে নির্দেশ দিয়েছিলেন হাই কোর্ট। ওই সময় বিচারপতি তারিক-উল হাকিম ও বিচারপতি মো. সোহরাওয়ার্দীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেছিলেন, ‘ঢাকা শহরে অনেক ভবন রয়েছে, যা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ও মোগল আমলের তৈরি। এসব স্থাপনা আমাদের ইতিহাসের সাক্ষী। জাতীয় স্বার্থেই এসব ঐতিহ্য রক্ষা করা প্রয়োজন।’

স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ‘জাহাজ বাড়ি’ ভবনটি তৈরি করা হয়েছে আনুমানিক ১৮৭০ সালে। ভবনের মালিক ১৯২০ সালে বদু হাজির নামে ওয়াকফ সম্পত্তি করে দিয়ে যান। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর বড় সন্তান ফেকু হাজি ভবনটির দায়িত্বে ছিলেন। ফেকু হাজির মৃত্যুর পর তাঁর বড় ছেলে হাজি আবদুল হক ভবনটির তত্ত্বাবধান করছেন।

আরবান স্টাডি গ্রুপের প্রধান নির্বাহী তাইমুর ইসলাম বলেন, তিনতলা ‘জাহাজ বাড়ি’র দোতলায় নকশা করা রেলিং, ছাদওয়ালা টানা বারান্দা ছিল। আর অবয়বজুড়ে ছিল নানা রকম কারুকাজসমৃদ্ধ। কোনাকৃতি আর্চের সারি, কারুকাজ করা কার্নিশ। কলামে ব্যবহার করা হয়েছে আয়নিক ও করিন্থিয়ান ক্যাপিটাল।

ভবনের পশ্চিম প্রান্তে আর্চ ও কলামের সঙ্গেও নানা রকম অলংকরণের ব্যবহার দেখা যায়। সব মিলিয়ে এই ভবনটিতে যে ধরনের অলংকরণের ব্যবহার রয়েছে, তা একে এক অনন্য মাত্রা দিয়েছে। এই ধরনের অলংকরণ পুরান ঢাকায় আর কোনো ভবনে দেখা যায় না। সেদিক থেকে এর নান্দনিক গুরুত্বের জন্যই ভবনটি সংরক্ষণ করা প্রয়োজন ছিল।