১৬তম দিনে ছাত্রলীগের পদবঞ্চিতদের অবস্থান, আলোচনায় 'সিন্ডিকেট'

রাজু ভাস্কর্যে ছাত্রলীগের পদবঞ্চিতদের অবস্থান। প্রথম আলো ফাইল ছবি
রাজু ভাস্কর্যে ছাত্রলীগের পদবঞ্চিতদের অবস্থান। প্রথম আলো ফাইল ছবি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে ছাত্রলীগের কমিটিতে পদবঞ্চিত ও প্রত্যাশিত পদ না পাওয়াদের অবস্থান আজ সোমবার ১৬ দিনে পা দিয়েছে। তবে নিজেদের চার দফা দাবি বাস্তবায়নে এখনো কোনো আশ্বাস পাননি তাঁরা। ছাত্রলীগের দায়িত্বশীল নেতা ও ছাত্রলীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, বিশেষ ‘সিন্ডিকেটের’ নির্দেশে পদবঞ্চিতরা রাজু ভাস্কর্যে অবস্থান করছেন।

ছাত্রলীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত চার নেতার একজন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেল হক আজ বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, ‘নেতৃত্বে আসার যোগ্য ছাত্রলীগের অন্তত ৫ হাজার নেতা-কর্মী আছে। কিন্তু কমিটি ৩০১ সদস্যের। ফলে সবাইকে কি আমরা খুশি করতে পারব? তাই কে প্রতিবাদ করল, কে ফুটপাতে বসে থাকল, তাতে কিছুই যায়-আসে না, মাথা ঘামানোর দরকার নেই। ছাত্রলীগ তার আপন গতিতেই চলবে।’

বি এম মোজাম্মেল হক অভিযোগ করেন, ‘এরা সিন্ডিকেট করে ছাত্রলীগকে ডুবিয়ে ফেলেছিল। ওটা থেকে শেখ হাসিনা ছাত্রলীগকে মুক্ত করেছেন। আমরা দায়িত্বপ্রাপ্ত চারজন কমিটি করিনি, আমরা কেবল তদারকি করেছি। ছাত্রলীগের বর্তমান ও সদ্য সাবেক সভাপতি-সাধারণ সম্পাদককে নিয়ে আলোচনা করেই কমিটি করা হয়েছে।’

ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীর অভিযোগ, ছাত্রলীগকে বিশেষ বলয়ের (সিন্ডিকেট) হাতে ফিরিয়ে নিতেই পদবঞ্চিতরা অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন। গতকাল রোববার রাতে রাব্বানী প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই অবস্থান কর্মসূচির উদ্দেশ্য ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটিকে বিতর্কিত করা, যাতে আপা (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) আর কখনো নিজে কমিটি করতে না চান। এর আগের তিনটি কমিটি বিভিন্ন মাধ্যমে (সিন্ডিকেট) হয়েছে। একটা বলয় ছিল, তারা স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সের নামে প্রহসন করেছে। তাই আমাদের চাওয়া ছিল, আপা নিজে যেন যাচাই-বাছাই করে কমিটিটা করেন। আপা যখন সেটি করলেন, ওই বলয়ের (সিন্ডিকেট) স্বার্থে আঘাত লেগেছে। তাই তাঁরা যে কোনোভাবে এই কমিটিটাকে বিতর্কিত করতে চাচ্ছে। এতে অভিমান করে আপা যদি নিজে কমিটি না করেন, তাহলে তারা আবার তাদের সেই স্বার্থের বলয়টা ফিরে পাবে।’

তবে পদবঞ্চিত অংশের নেতৃত্বে থাকা ছাত্রলীগের সাবেক প্রচার সম্পাদক সাঈফ বাবু এবং তাদের অবস্থান কর্মসূচির মুখপাত্র সংগঠনের সাবেক কর্মসূচি ও পরিকল্পনাবিষয়ক সম্পাদক রাকিব হোসেন ‘সিন্ডিকেটের’ নির্দেশ বাস্তবায়নের এই অভিযোগকে উড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁদের দাবি, অভিযোগটি মিথ্যা ও মনগড়া। রাকিবের অভিযোগ, ‘বর্তমান কমিটিতে সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীই সিন্ডিকেটের একমাত্র লোক। সিন্ডিকেট বলতে তিনি যাঁকে বুঝিয়েছেন, তিনি নিজেও তাঁর লোক।’

ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী বলেন, ‘১৫ দিন কেন, ১৫ মাস হলেও কিছু করার নেই। একজনও আমাদের কাছে এখনো লিখিত অভিযোগ দেয়নি। ছাত্রলীগের সাংগঠনিক প্রক্রিয়া মেনে অভিযোগ না দিয়ে রাজু ভাস্কর্যে বসে থেকে লাভ কী? আমি দুইবার তাঁদের কাছে গিয়ে অভিযোগ ও চাওয়াগুলো জানানোর অনুরোধ করেছি। সেটা যদি তাঁরা না করেন, কী করার আছে? আমরা নিজেরা স্বপ্রণোদিত হয়ে ১৯ জনের পদ শূন্য ঘোষণা করেছি।’

পদ শূন্য ঘোষণা নিয়ে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের ভিন্ন বক্তব্য
আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে ৩০১ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে ১৯ জন ‘বিতর্কিত’ নেতাকে বাদ দেয় ছাত্রলীগ। ২৮ মে রাতে ওই ১৯ জনের পদ শূন্য ঘোষণা করে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দেন ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। তবে বিজ্ঞপ্তিতে ওই ১৯ জনের নাম প্রকাশ করা হয়নি।

এর আগে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণার পর বিতর্কিতদের নিয়ে সরব হয়ে ওঠেন কমিটিতে পদবঞ্চিতরা। এরপর ১৫ মে দুপুরে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিতর্কিতদের বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন। পরে ওই দিন মধ্যরাতে ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে বিতর্কিতদের বহিষ্কারে ২৪ ঘণ্টা সময় নেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী। সেখানে চিহ্নিত ১৭ জনের মধ্যে বিতর্কিত ১৬ জনের নামও প্রকাশ করেন তাঁরা।

ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী এত দিন বলে এসেছেন, যে ১৬ জনের নাম তাঁরা সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, তাদের ৮ জন নিজেদের পক্ষে দালিলিক তথ্য-প্রমাণ দিয়েছেন যে তাঁরা নির্দোষ। তাদের বাইরেও কয়েকজনের ব্যাপারে তাঁরা আপত্তি পেয়েছিলেন। সব মিলিয়ে ১৯ জনের ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে দেখা গেছে, তাদের ব্যাপারে অধিকতর তদন্তের প্রয়োজন আছে। পরে ২৮ মে তাঁদের পদ শূন্য ঘোষণা করা হয়।

গতকাল রোববার রাতে গোলাম রাব্বানী বলেন, ‘অভিযোগের ভিত্তিতে পদ শূন্য ঘোষণা করা হয়েছে, কিন্তু অভিযোগগুলো এখনো চূড়ান্তভাবে প্রমাণিত হয়নি। যদি তাঁরা অভিযোগগুলোর বিপরীতে তথ্য-প্রমাণ দিতে পারেন এবং আমরা যদি আমাদের সাংগঠনিক নেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনাকে সেগুলো দেখিয়ে কনভিন্স করতে পারি, তাহলে তাঁদের আবার স্বপদে বহাল রাখা হবে। ১৯টি পদ শূন্য ঘোষণার বিষয়টিকে একধরনের বিভাগীয় ব্যবস্থা (ডিপার্টমেন্টাল ওএসডি) বলা যেতে পারে। আগামী পরশু আমরা আপার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাব।’

তবে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেল হক বলছেন, অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে বলেই ওই ১৯ জনের পদ শূন্য ঘোষণা করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘প্রথমে বিতর্কিত ১৭ জনের নাম ঘোষণা করা হয়েছিল, এর সঙ্গে পরে আর দুজন যোগ হয়। তাঁদের পদ শূন্য ঘোষণা করা হয়েছে। আরও দুই-চারজন বিতর্কিত থাকতে পারে- সেটি আমরা যাচাই-বাছাই করে দেখছি। তালিকাটা নেত্রীর কাছে এখনো দেওয়া হয়নি, দু-এক দিনের মধ্যে দেওয়া হবে।’

রাব্বানীর বক্তব্যকে ‘মাই ম্যানদের বাঁচানোর পাঁয়তারা’ হিসেবে দেখছেন পদবঞ্চিতদের মুখপাত্র রাকিব হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সংগঠন তো কোনো ছেলেখেলা না। তিনি একবার ১৯ জনের পদ শূন্য করবেন, আবার পুনর্বহাল করার কথা বলবেন, তা তো হয় না। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নিজেদের কাছের লোকদের বাঁচানোর জন্যই এ ধরনের কথাবার্তা বলছেন। নিজেদের বলয় টেকানো ও বিভিন্ন ধরনের ‘দায়বদ্ধতার’ কারণেই তাঁরা এ ধরনের কথা বলছেন।’

পদবঞ্চিতদের চার দফা দাবি
চার দফা দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে ১৬ দিন ধরে অবস্থান করছেন ছাত্রলীগের পদবঞ্চিতরা। দাবিগুলো হলো, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ, কমিটি থেকে বিতর্কিতদের বাদ দেওয়া, যোগ্যদের কমিটিতে পদায়ন এবং মধুর ক্যানটিন ও টিএসসিতে পদবঞ্চিতদের ওপর হামলার সুষ্ঠু বিচার।

পদবঞ্চিতদের নেতৃত্বে থাকা সাঈফ বাবু বলেন, ‘বিতর্কিতদের বাদ দিয়ে যোগ্যদের পদায়ন করলেই আমরা কর্মসূচি স্থগিত করব। আমাদের কথাগুলো জানাতে আমরা নেত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চাই।’