আ.লীগের প্রচারে 'উন্নয়ন', বিএনপির 'খালেদার মুক্তি'

নির্বাচনী প্রচারে আওয়ামী লীগের প্রার্থী এস টি জামান নিকেতা। ছবি: প্রথম আলো
নির্বাচনী প্রচারে আওয়ামী লীগের প্রার্থী এস টি জামান নিকেতা। ছবি: প্রথম আলো

বগুড়া-৬ শূন্য আসনে জমে উঠেছে নির্বাচনী প্রচারণা। সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত গণসংযোগ, কর্মিসভা, উঠান বৈঠক, নিজ নিজ প্রতীক–সংবলিত প্রচারপত্র বিলি ছাড়াও ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে নানান প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোট চাইছেন প্রার্থীরা। দুপুর গড়ালেই শহরজুড়ে চলছে মাইকিং করে গানে গানে ভোট প্রার্থনা। ভোটের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে, নির্বাচনের মাঠ ততই সরগরম হয়ে উঠছে।

ভোটাররা বলছেন, নির্বাচনের মাঠে সাতজন প্রার্থী থাকলেও মূল লড়াই হবে বড় দুই দল আওয়ামী এবং বিএনপির দলীয় প্রতীক নৌকা ও ধানের শীষের প্রার্থীদের মধ্যে। ধানের শীষের প্রার্থী জিএম সিরাজ এর আগে বগুড়ার অন্য একটি আসন থেকে বিএনপির মনোনয়নে টানা তিন দফা সাংসদ নির্বাচিত হলেও নৌকার প্রার্থী এস টি জামান নিকেতা এবারই প্রথম সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এ কারণে ২৪ জুন অনুষ্ঠেয় নির্বাচনী লড়াই হবে ভোটের রাজনীতিতে নবীনের সঙ্গে প্রবীণের। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রচারণায় সরকারের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে নৌকায় ভোট চাওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি, তারেক রহমানকে দেশে ফেরানো ছাড়াও জিয়া পরিবারের অত্যন্ত মর্যাদার এই আসন ধরে রাখতে ধানের শীষে ভোট চাইছে বিএনপি।

আজ সোমবার দিনভর প্রার্থীরা নিজেদের প্রতীকে ভোট চেয়ে শহর ও শহরতলিতে গণসংযোগ করেন।
রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বগুড়া সদর উপজেলার ১১টি ইউনিয়ন এবং একটি পৌরসভার ২১টি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত বগুড়া-৬ আসন। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী ২৪ জুন ইলেকট্রিক ভোটিং মেশিনে ভোট গ্রহণ হবে। নির্বাচনে ভোটারসংখ্যা ৩ লাখ ৮৭ হাজার ৪৫৮।

নির্বাচনে অন্য প্রার্থীরা হলেন জাতীয় পার্টির নুরুল ইসলাম ওমর, বাংলাদেশ কংগ্রেসের মনসুর রহমান, বাংলাদেশ মুসলিম লীগের রফিকুল ইসলাম, স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. মিনহাজ এবং সৈয়দ কবির আহম্মেদ।

বগুড়া-৬ আসনে নির্বাচনী প্রচারে বিএনপির প্রার্থী জি এম সিরাজ। ছবি: প্রথম আলো
বগুড়া-৬ আসনে নির্বাচনী প্রচারে বিএনপির প্রার্থী জি এম সিরাজ। ছবি: প্রথম আলো

আজ দিনভর বিএনপির জিএম সিরাজ দলীয় নেতা–কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে শহরের সূত্রাপুর থেকে কালীতলা পর্যন্ত গণসংযোগ ছাড়াও ১, ২, ৩ এবং ১২ নম্বর ওয়ার্ডে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটারদের কাছে ধানের শীষে ভোট চেয়ে প্রচারপত্র বিলি করেন। এ সময় বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি, তারেক রহমানকে দেশে ফেরানো এবং জিয়া পরিবারের মর্যাদার আসন ধরে রাখতে ভোটারদের কাছে ধানের শীষ প্রতীকে ভোট চাওয়া হয়।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯১ থেকে ২০০১ সালের নির্বাচন পর্যন্ত ধানের শীষ প্রতীকে বগুড়া-৫ (শেরপুর-ধুনট) আসনে সাংসদ ছিলেন জি এম সিরাজ। এক–এগারোর পর মান্নান ভূঁইয়ার নেতৃত্বাধীন সংস্কারপন্থীদের পক্ষ নেওয়ায় ২০০৮ সালের নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন বঞ্চিত হন তিনি। টানা ১০ বছর দলে নিষ্ক্রিয় থাকার পর ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনে তাঁকে নিজ আসন থেকে ফের মনোনয়ন দেওয়া হয়। কিন্তু নির্বাচনে তিনি পরাজিত হন। গত ১৫ মে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জি এম সিরাজকে আহ্বায়ক করে জেলা বিএনপির কমিটি ঘোষণা দেন। পরে শূন্যঘোষিত বগুড়া-৬ আসনে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয় তাঁকে। তিনি এস আর গ্রুপের চেয়ারম্যান।
জি এম সিরাজ সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘মানুষের ভালোবাসা নিয়েই ভোটযুদ্ধে নেমেছি। ঘরে ঘরে গিয়ে ভোট চাইছি। এখানে বিএনপির অবস্থান অত্যন্ত সুদৃঢ়। অনেক দিন পর স্থানীয় কোনো প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন ভোটাররা। জয়ের ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী।’

সিরাজের দাবি, শূন্য আসনে নির্বাচনে ধানের শীষের প্রচারণায় ভোটারদের স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া মিলছে। ভোটারদের বোঝানো হচ্ছে দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের জন্মভিটার এই আসনটি জিয়া পরিবারের সংরক্ষিত ও অত্যন্ত মর্যাদার আসন। ২০১৪ সালে বিএনপির ‘বয়কট’ নির্বাচন ছাড়া ১৯৭৯ সাল থেকে আসনটি বিএনপির দখলে ছিল। কৌশলগত কারণে দলীয় মহাসচিব শপথ না নেওয়ায় শূন্য আসনে ভোট গ্রহণ করা হচ্ছে। জিয়া পরিবারের মর্যাদার আসনটি ধরে রাখতে ধানের শীষে ভোট দিতে হবে।

আজ শহরের নিউমার্কেট এলাকা ছাড়াও দলীয় নেতা–কর্মীরা একাধিক দলে বিভক্ত হয়ে শহর ও শহরতলি এলাকায় নৌকার পক্ষে ভোট চেয়ে প্রচারণায় অংশ নেন। আওয়ামী লীগের প্রার্থী এস টি জামান নিকেতা ভোট চেয়ে গত রোববার সন্ধ্যায় গণসংযোগ করেন শহরের নিউমার্কেট এলাকায়। এ সময় সরকারের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে নৌকায় ভোট চান তিনি।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, টি জামান নিকেতা বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচিত সাংস্কৃতিক সম্পাদক, জেলা ছাত্রলীগের সম্পাদক এবং জেলা যুবলীগের সভাপতি ছিলেন। এ ছাড়া সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্পাদক এবং জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তিনি জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক।

নিকেতা বলেন, বারবার একটি বিশেষ দলের প্রতীকের ফাঁদে পা দিয়ে নানাভাবে প্রবঞ্চিত, নিপীড়িত, অবহেলিত বগুড়াবাসী। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার প্রতি সম্মান–শ্রদ্ধা দেখিয়ে উন্নয়নের আশায় বারবার বগুড়াবাসী তাঁকে ভোট দিলেও তিনি নির্বাচিত হওয়ার পর আসনটি ছেড়ে দিয়ে ভোটারদের অসম্মান করেছেন।

টি জামান বলেন, ‘দলের গণবিরোধী কর্মকাণ্ডের জন্য ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে ভোটাররা বিএনপি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন। দেশজুড়ে বিএনপির ভরাডুবি হয়। অথচ বগুড়া সদর আসনে ঠাকুরগাঁও থেকে ধার করে আনা “অতিথি প্রার্থী” ও বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে বিপুল ভোট দিয়ে বিজয়ী করেন বগুড়াবাসী। কিন্ত বিজয়ী হওয়ার পর তিনি ভোটারদের প্রতি চরম অবজ্ঞা ও অসম্মান দেখিয়ে শপথ নেওয়া থেকে বিরত থাকেন। ২৪ জুন নির্বাচনে নৌকায় ভোট দিয়ে বারবার বঞ্চনা আর অসম্মানের শোধ নেওয়ার সুযোগ এসেছে ভোটারদের কাছে। ভোটাররা সে সুযোগ হাতছাড়া করবেন না।’

বগুড়া-৬ (সদর) আসনটি জিয়া পরিবারের জন্য ‘সংরক্ষিত’ আসন হিসেবে পরিচিত। ১৯৭৯ থেকে ২০০৮ সালের নির্বাচন পর্যন্ত আসনটি একচ্ছত্র দখলে ছিল বিএনপির। এর মধ্যে ১৯৯১ সালের নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীকে বিজয়ী হয়েছিলেন সাবেক অর্থ প্রতিমন্ত্রী প্রয়াত মুজিবর রহমান। ১৯৯৬, ২০০১ এবং ২০০৮ সাল ছাড়াও বাতিল হওয়া ২২ জানুয়ারির নির্বাচনে টানা চার দফা বিপুল ভোটে বিজয়ী হন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এর মধ্যে ২০০৮ সালের নির্বাচনে ১ লাখ ৯৩ হাজার ৭৯২ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন তিনি। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জেলা আওয়ামী লীগের প্রয়াত সভাপতি মমতাজ উদ্দিন ভোট পান ৭৪ হাজার ৬৩৪।