বাসির ও মিজানের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি টিআইবির

মিজানুর রহমান ও খন্দকার এনামুল বাসির
মিজানুর রহমান ও খন্দকার এনামুল বাসির

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পরিচালক খন্দকার এনামুল বাসির এবং ডিআইজি মিজানুর রহমানের মধ্যে ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ তদন্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।

গতকাল মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে সংস্থাটি উভয়ের বিরুদ্ধে তদন্ত করে শাস্তির এই দাবি জানিয়েছে।

টিআইবি বলছে, তদন্ত কর্মকর্তার দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করার সুযোগ নেই। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দুদকের পক্ষে এর দায় কোনোভাবেই এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। একই সঙ্গে ঘুষ লেনদেনে জড়িত পুলিশ কর্মকর্তার সব অনিয়মের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার দায়ও পুলিশ প্রশাসনের পাশাপাশি দুদকের।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে আমরা জেনেছি যে “তথ্য পাচার, চাকরির শৃঙ্খলাভঙ্গ ও অসদাচরণের অভিযোগে” খন্দকার এনামুল বাসিরকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। দুদকের তদন্ত কমিটি পূর্ণাঙ্গ তদন্তের সুপারিশ করেছে। দুদকের কর্মকর্তা–কর্মচারীদের একাংশের বিরুদ্ধে অভিযোগ দীর্ঘকালের, যা সর্বজনবিদিত। দুদক কর্তৃপক্ষ, বর্তমান চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে এ বিষয়ে এর আগে একাধিকবার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে বলে জানা যায়। কিন্তু তা যে বাস্তবে কোনো কার্যকর ফল দেয়নি, তার প্রমাণ এ আলোচিত ঘটনা। তাই এ ধরনের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে যথাযথ প্রক্রিয়ায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করে রীতিমতো শুদ্ধি অভিযান পরিচালিত করতে না পারলে দুদকের ওপর মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনা অসম্ভব হবে। একই সঙ্গে দুর্নীতিরও আরও ব্যাপক বিস্তার ঘটবে। দেশে দুর্নীতি প্রতিরোধের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিশেষায়িত কর্তৃপক্ষের ওপর দেশের মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে দ্রুততম সময়ের মধ্যে এ তদন্ত শেষ করে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।’

ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘ব্যক্তির দায় প্রতিষ্ঠান নেবে না—দুদকের এমন অবস্থান আমাদের শুধু হতাশই করেনি, বরং আমরা বাংলাদেশে দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রমের ভবিষ্যৎ নিয়ে রীতিমতো শঙ্কিত বোধ করছি। একজন উচ্চপদস্থ তদন্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তথ্য–প্রমাণসহ দুর্নীতির অভিযোগ আসার পর আমাদের প্রত্যাশা ছিল দুদক একে একটা প্রাতিষ্ঠানিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেবে এবং তাদের অন্য কোনো কর্মকর্তাও যে এমন কর্মকাণ্ডে জড়িত নন, তা নিশ্চিত করতে দৃশ্যমান, বিশ্বাসযোগ্য ও কার্যকর পদক্ষেপ নেবে। দুদক নিজেই যদি স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক ও দুর্নীতিমুক্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে না পারে, তাহলে তাদের কার্যক্রমের ওপর জনগণের আস্থা থাকবে কী করে?’

পাশাপাশি ‘জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ’ থেকে অব্যাহতি পেতে পুলিশের ডিআইজি মিজানুর রহমান রহমান ঘুষ দেওয়ার কথা প্রকাশ্যে স্বীকার করার পরও স্বপদে বহাল থাকায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক। তিনি বলেন, ‘ঘুষ লেনদেনে জড়িত দুই পক্ষই সমানভাবে দায়ী। বিশেষ করে যখন কোনো ব্যক্তি দুর্নীতির অভিযোগ থেকে পার পেতে ঘুষ দেন, তখন তাঁর অপরাধের মাত্রা আরও গুরুতর হয়। অথচ গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে আমরা জেনেছি যে পুলিশ প্রশাসন এখনো কোনো পদক্ষেপই নেয়নি। তারা তদন্ত করে দেখার কথা বললেও সেটা কবে শুরু বা শেষ হবে, তা আমরা জানি না। আমরা এটাও জানি না যে শেষ পর্যন্ত এই অভিযোগও ধামাচাপা পড়ে যাবে কি না। “নারী নির্যাতন ও ক্ষমতার অপব্যবহারের” মতো গুরুতর অপরাধের অভিযোগ থাকার পরও যখন এই পুলিশ কর্মকর্তা স্বপদেই বহাল রয়েছেন, তখন এমন কিছু হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। পুলিশ প্রশাসন তাদের ওপর জনগণের আস্থা সম্পর্কে কোনো তোয়াক্কা করে কি না, সেটাই এখন প্রশ্ন।’

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতার’ যে ঘোষণা দিয়েছেন, তা স্মরণ করিয়ে দিয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক এই ন্যক্কারজনক ঘটনায় জড়িত দুই পক্ষের বিরুদ্ধেই দ্রুততম সময়ের মধ্যে কার্যকর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান। পুলিশ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক যথাযোগ্য বিভাগীয় পদক্ষেপের পাশাপাশি দুর্নীতিসংক্রান্ত অভিযোগের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার জবাবদিহি নিশ্চিতে দুদকের ভূমিকার অপরিহার্যতা দ্বিগুণ বেড়েছে বলে মন্তব্য করেন ড. ইফতেখারুজ্জামান।

নারী নির্যাতনের অভিযোগে দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার হওয়া ডিআইজি মিজানুর রহমানের অবৈধ সম্পদের তদন্ত শুরু করেছিল দুদক। কিন্তু এই তদন্ত করতে গিয়ে দুদকের পরিচালক খন্দকার এনামুল বাসির ৪০ লাখ টাকা ঘুষ নিয়েছেন বলে অভিযোগ করেন মিজানুর রহমান। মাস ছয়েক ধরে দুজনের মধ্যে এ নিয়ে অনেক কথাবার্তা হয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে প্রথমে ২৫ লাখ ও পরে ১৫ লাখ টাকা দিয়েছেন মিজানুর। কিন্তু ২ জুন খন্দকার এনামুল বাসির মিজানুরকে জানান, তিনি প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। তবে দুদক চেয়ারম্যান ও কমিশনারের চাপে তাঁকে অব্যাহতি দিতে পারেননি। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে মিজানুর টাকাপয়সা লেনদেনের সব কথা ফাঁস করে দেন। প্রমাণ হিসেবে হাজির করেন এনামুল বাসিরের সঙ্গে কথোপকথনের একাধিক অডিও রেকর্ড।

এরপরই খন্দকার এনামুল বাসিরকে সাময়িক বরখাস্ত করে দুদক। তবে তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগে দুদক বিব্রত নয় বলে গত সোমবার দুদক কার্যালয়ে সাংবাদিকদের কাছে মন্তব্য করেন সংস্থাটির চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ।

এনামুল বাসিরের বিরুদ্ধে অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত রোববার তদন্ত কমিটি গঠন করেছে দুদক। কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে কমিশনের সচিব মো. দিলওয়ার বখতকে। অন্য সদস্যরা হলেন মহাপরিচালক (লিগ্যাল) মো. মফিজুর রহমান ভূঞা ও মহাপরিচালক (প্রশাসন) সাঈদ মাহবুব খান।

ঘুষ লেনদেনের অডিও প্রসঙ্গে গতকাল প্রথম আলোকে খন্দকার এনামুল বাসির বলেন, ‘সেদিনের খোশগল্পই বিকৃত করে উপস্থাপন করে আমাকে ফাঁসানো হয়েছে। ডিআইজি মিজানুর রহমানের সঙ্গে খোশগল্প করছিলাম। মিজান তাঁর দুঃখের কথা বলতে গিয়ে বলেছিলেন, ডিএমপির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তাঁকে নারী কেলেঙ্কারিতে ফাঁসান। আমি বলেছিলাম, ছয় বছর ধরে একই পদে চাকরি করছি, কোনো প্রমোশন নেই। প্রমোশন হলে এখন আমার গাড়ি থাকত। ছেলেমেয়ের যাতায়াতে সুবিধা হতো।’