ঘোড়ার গাড়ির ইয়াসিন

ঘোড়ার গাড়িতে শুয়ে আছে ইয়াসিন। গুলিস্তান, ঢাকা, ১২ জুন। ছবি: আবদুস সালাম
ঘোড়ার গাড়িতে শুয়ে আছে ইয়াসিন। গুলিস্তান, ঢাকা, ১২ জুন। ছবি: আবদুস সালাম

মায়ের কথা জিজ্ঞাসা করতেই কান্না জুড়ে দিল ছোট্ট শিশুটি। সে আর কথা বলতে পারে না। এমনিতেই চাপা স্বরে কথা বলে ১০ বছর বয়সের শিশুটি। চোখেমুখে কী এক শোকের ছায়া। রাজধানীতে ঘোড়ার গাড়ির সহকারী হিসেবে কাজ করে। ঠিক মনে নেই কবে ঘোড়ার গাড়ির পাদানিতে পা রেখে তার এ জীবনের শুরু।

আজ বুধবার দুপুরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ভবনের সামনে তার সঙ্গে কথা হচ্ছিল। শিশুর নাম ইয়াসিন।

দৈনিক এক শ টাকা মজুরিতে ফুলবাড়িয়ার নূর আলমের গাড়িতে কাজ করে ইয়াসিন। জন্ম মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার ষোলঘর ইউনিয়নে। বাবা মো. আসলাম সৌদিপ্রবাসী ছিলেন। কয়েক মাস আগে ইয়াসিনের মা মারা যান। এরপরই তার বাবা আসলাম ঢাকায় এসে রিকশা–ভ্যান চালানো শুরু করেন। ইয়াসিন মুন্সিগঞ্জে আত্মীয়দের কাছেই ছিল। কিছুদিন আগে সে–ও ঢাকায় পাড়ি জমায়। ঢাকায় এসে কাজ খুঁজে পেলেও বাবার সান্নিধ্য আর পায়নি সে। আসলাম মাঝেমধ্যে ছেলেকে ১০–২০ টাকা দেন কিন্তু দায়িত্ব নিতে রাজি নন। উপায় না দেখে কিছুদিন আগে ঘোড়ার গাড়িতে কাজ নেয় ছোট্ট ইয়াসিন।

অল্প বয়সেই জীবনসংগ্রামে নেমে পড়তে হয়েছে ইয়াসিনকে। গুলিস্তান, ঢাকা, ১২ জুন। ছবি: আবদুস সালাম
অল্প বয়সেই জীবনসংগ্রামে নেমে পড়তে হয়েছে ইয়াসিনকে। গুলিস্তান, ঢাকা, ১২ জুন। ছবি: আবদুস সালাম

দুপুরে যখন কথা হচ্ছিল, তখন ইয়াসিন জানাল, সকাল থেকে রোদে পুড়ে কাজ করতে হয়। রুটি খেয়ে গাছের ছায়ায় একটু জিরিয়ে নিচ্ছিল। একটু চাপা স্বভাবের। এক প্রশ্ন একাধিকবার করলে বুঝতে পারে। ইয়াসিন জানাল, হোটেলে ভাত খাওয়া হয় মাঝেমধ্যে। ঘোড়ার গাড়ি থেকে যে আয় হয়, প্রতি বেলা ভাত খেতে গেলে আয়ের টাকায় দিন চলবে না। আলাপের একপর্যায়ে তার মায়ের কথা জানতে চাইলে, মায়ের নাম মনে করতে পারল না। মায়ের কথা মনে পড়ে কি না, প্রশ্ন করতেই কেঁদে ফেলল ছোট্ট ইয়াসিন। আর কথা এগোয়নি।

সারা দিন রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে সকাল দশটা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করে ইয়াসিন। গুলিস্তান থেকে সদরঘাট, সদরঘাট থেকে গুলিস্তান আসা–যাওয়া। চিৎকার করে যাত্রীদের ডেকে গাড়িতে তোলা তার অন্যতম দায়িত্ব। একটু ভুল হলেই গালি খেতে হয়। অনেক সময় ঘোড়ার জন্য তৈরি চাবুকটি ইয়াসিনের গায়েও পড়ে। তার হাড্ডিসার শরীরের বিভিন্ন স্থানে ক্ষতের চিহ্ন। রাতে ঘুমিয়ে পড়ে ফুলবাড়িয়ায় কোনো একটি ঘোড়ার গাড়িতেই।

আজ বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এবারের প্রতিপাদ্য ‘শিশুশ্রম নয়, শিশুর জীবন হোক স্বপ্নময়’। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের পরিস্থিতি অনেকটাই ভিন্ন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ জরিপ ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রায় ১৬ লাখ ৯৮ হাজার ৮৯৪ শিশু শ্রমজীবী। এদের প্রায় ৭৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ (১২ লাখ ৮০ হাজার ১৯৫টি শিশু) বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত।