জন্মবার্ষিকীতে দ্বিজেন শর্মার স্মরণে গাছের চারা বিতরণ

দ্বিজেন শর্মার স্মরণে তরুপল্লবের উদ্যোগে গাছের চারা বিতরণ করা হয়। শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ প্রাঙ্গণে। ছবি: প্রথম আলো
দ্বিজেন শর্মার স্মরণে তরুপল্লবের উদ্যোগে গাছের চারা বিতরণ করা হয়। শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ প্রাঙ্গণে। ছবি: প্রথম আলো

চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় তাঁর ছবিটি রাখা। ছবির গলায় মালা। সামনে নানা রকমের ফুলের তোড়া। কারও ছবিতে ফুলের উপস্থিতি থাকলে বুঝে নিতে হয় মানুষটা নেই। শিক্ষক, লেখক, অনুবাদক ও প্রকৃতিবিদ দ্বিজেন শর্মা না–ফেরার দেশে চলে গেছেন ২০১৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর। তাঁর ৯০তম জন্মবার্ষিকী ছিল ২৯ মে। সে উপলক্ষে আজ শুক্রবার অনুরাগীরা দ্বিজেন শর্মার না থাকার বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে জন্মদিন উদ্‌যাপন করেছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ প্রাঙ্গণে শুক্রবার সকালে সমবেত হয়েছিলেন অর্ধশত মানুষ। জন্মদিন ঘিরে এই প্রকৃতিবিদের জীবন ও কর্ম নিয়ে স্মৃতিচারণার আয়োজন করে তরুপল্লব। যেখানে প্রিয়জনেরা তাঁকে কথামালায় স্মরণ করলেন। বিতরণ করা হলো গাছের চারা। অনুষ্ঠানে দ্বিজেন শর্মা স্মরণে প্রবর্তিত ‘তরুপল্লব দ্বিজেন শর্মা নিসর্গ পুরস্কার-২০১৯’ বিজয়ীর নাম ঘোষণা করা হয়। এবার এ পুরস্কার পাচ্ছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মনোয়ার হোসেন। আগামী ১৫ সেপ্টেম্বর দ্বিজেন শর্মার প্রয়াণ দিবসে আনুষ্ঠানিকভাবে এ পুরস্কার তুলে দেওয়া হবে।

অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আনোয়ারুল ইসলাম, পাখি বিশেষজ্ঞ ইনাম আল হক, কৃষিবিদ হামিদুর রহমান, লেখক ও অধ্যাপক আমিরুল আলম খান, স্থপতি তুঘলক আজাদ, লেখক ও রাজনীতিবিদ ফিরোজ আহমেদ, তরুপল্লবের সদস্য গোলাম শফিক, ইমাম হোসেন গাজী, রাজিয়া সামাদ ডালিয়া, লিলি হক, হেনা সুলতানা প্রমুখ। সভাপতিত্ব করেন দ্বিজেন শর্মার স্ত্রী দেবী শর্মা।

বক্তারা বলেন, প্রকৃতিবিদ দ্বিজেন শর্মার সারা জীবনের সাধনা ছিল প্রকৃতির প্রতি মানুষের ভালোবাসা জাগানো। তিনি মানুষকে প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে মনে করতেন; ব্যবহারিক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রকৃতিকে অর্থনৈতিক সম্পদ হিসেবে দেখার ঘোর বিরোধী ছিলেন। কয়েক প্রজন্মের মাঝে প্রকৃতি ও বিজ্ঞানের আলো ছড়িয়ে গেছেন। তাঁর আদর্শে উজ্জীবিত তরুণেরাই প্রকৃতি সংরক্ষণ আন্দোলনে আগামী দিনের নেতৃত্ব দেবেন।

দ্বিজেন শর্মাকে একই সঙ্গে কবি ও বিজ্ঞানী উল্লেখ করে বক্তারা বলেন, তাঁর লেখায় আলাদা কাব্যময়তা আছে। তিনি সাহিত্য ও বিজ্ঞানের অনন্য সংশ্লেষ ঘটিয়েছেন।

অনুষ্ঠান প্রাঙ্গণে দ্বিজেন শর্মার প্রতিকৃতি। ছবি: প্রথম আলো
অনুষ্ঠান প্রাঙ্গণে দ্বিজেন শর্মার প্রতিকৃতি। ছবি: প্রথম আলো

অনুষ্ঠানে দ্বিজেন শর্মা স্মরণে প্রবর্তিত ‘তরুপল্লব দ্বিজেন শর্মা নিসর্গ পুরস্কার-২০১৯’ বিজয়ীর নাম ঘোষণা করা হয়। উপস্থিত প্রকৃতিপ্রেমীদের মাধবীলতা, অ্যালডার ফ্লাওয়ার, মালবেরি, ট্রাম্পিটলতা, নীলমণিলতা, লিলি, বাসক ইত্যাদি গাছের চারা বিতরণ করা হয়। আয়োজনের শেষে ছিল মুড়ি-মুড়কি, ফলসহ বিচিত্র খাবারের সমন্বয়ে আপ্যায়ন।

প্রসঙ্গত, ২০০৮ সালের ৫ ডিসেম্বর রমনা পার্কে গাছ চেনানোর অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে তরুপল্লবের যাত্রা শুরু হয়। প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক এ সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন দ্বিজেন শর্মা। তরুপল্লব এ পর্যন্ত ২৯টি গাছ চেনানোর অনুষ্ঠান, উদ্যানকর্মীদের নিয়ে কর্মশালা, বৃক্ষরোপণ ও প্রকৃতিবিষয়ক সাময়িকী প্রকৃতিপত্র প্রকাশসহ নানামুখী সমাজসচেতনমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে।

১৯২৯ সালের ২৯ মে তৎকালীন সিলেট বিভাগের বড়লেখা থানার শিমুলিয়া গ্রামে দ্বিজেন শর্মার জন্ম। হাতেখড়ি, পাঠশালায় পড়াশোনা ও বেড়ে ওঠা পাথারিয়া পাহাড়ের অপরূপ নৈসর্গিক পরিবেশে, যার গভীর ছাপ তাঁর মনে আজীবন রয়ে গেছে। তিনি কলকাতা সিটি কলেজ থেকে বিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি লাভের পর বরিশালের ব্রজমোহন কলেজে উদ্ভিদবিজ্ঞানের ডেমোনস্ট্রেটর হিসেবে যোগ দেন ১৯৫৮ সালে। ১৯৬৪ সালে ঢাকার নটর ডেম কলেজে যোগ দেন এবং ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত সেখানে শিক্ষকতা করেন। ওই কলেজের প্রাঙ্গণে তিনি অনেক গাছ লাগান, যার কিছু আজও রয়ে গেছে।

অনুবাদ ছাড়াও তিনি প্রায় ৩০টি বই লিখেছেন। সেসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য শ্যামলী নিসর্গ, ডারউইন ও প্রজাতির উৎপত্তি, সতীর্থবলয়ে ডারউইন, সপুষ্পক উদ্ভিদের শ্রেণিবিন্যাস, সমাজতন্ত্রে বসবাস, বিজ্ঞান ও শিক্ষা: দায়বদ্ধতার নিরিখ, জীবনের শেষ নেই, ফুলগুলি যেন কথা, গাছের কথা ফুলের কথা, নিসর্গ নির্মাণ ও নান্দনিক ভাবনা, গহন কোন বনের ধারে ইত্যাদি। দ্বিজেন শর্মা এশিয়াটিক সোসাইটির বাংলাপিডিয়া প্রকল্পের অন্যতম সম্পাদক ছিলেন। মননশীল লেখালেখির জন্য তিনি ১৯৮৭ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। তাঁকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয় ২০১৫ সালে।