সুন্দরবনের বিশ্ব-ঐতিহ্যের সম্মান ঝুঁকির মুখে

চারপাশে শিল্পের প্রসারে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে সুন্দরবন। জীববৈচিত্র্য পড়েছে হুমকিতে। সম্প্রতি খুলনার দাকোপ উপজেলার ঢাংমারী এলাকাসংলগ্ন সুন্দরবনে।  ছবি: সাদ্দাম হোসেন
চারপাশে শিল্পের প্রসারে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে সুন্দরবন। জীববৈচিত্র্য পড়েছে হুমকিতে। সম্প্রতি খুলনার দাকোপ উপজেলার ঢাংমারী এলাকাসংলগ্ন সুন্দরবনে। ছবি: সাদ্দাম হোসেন
>ইউনেসকোর সুপারিশ
সুন্দরবন রক্ষায় বাংলাদেশ সরকারের করা অঙ্গীকার বাস্তবায়নের অগ্রগতি খুবই ধীর

সুন্দরবনকে রক্ষায় বাংলাদেশ সরকার যেসব অঙ্গীকার করেছিল, তা যথাযথভাবে পূরণ করা হচ্ছে না বলে মনে করে জাতিসংঘের বিজ্ঞান, শিক্ষা ও ঐতিহ্যবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো। এ অবস্থায় সুন্দরবনকে বিশ্ব–ঐতিহ্যের ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করেছে ইউনেসকোর বিশ্ব–ঐতিহ্য কমিটি।

এর কারণ হিসেবে সংস্থাটি বলেছে, সুন্দরবনের বিশ্ব–ঐতিহ্যের সম্মান অটুট রাখতে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ বন্ধ রাখা ও এর চারপাশের শিল্পকারখানার অনুমোদন না দেওয়ার অঙ্গীকার বাস্তবায়নে বাংলাদেশ সরকারের অগ্রগতি খুবই ধীর। অন্যদিকে সরকার সুন্দরবনের ২০ কিলোমিটারের মধ্যে দুটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজ এগিয়ে নিচ্ছে, যা সুন্দরবনের জন্য আরও বড় হুমকি তৈরি করবে।

চলতি সপ্তাহে বিশ্ব–ঐতিহ্য কমিটি সুন্দরবনকে ঝুঁকিপূর্ণ বিশ্ব–ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ প্রকাশ করেছে। ৩০ জুন থেকে আগামী ১০ জুলাই পর্যন্ত আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে বিশ্ব–ঐতিহ্য কমিটির বার্ষিক সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হবে। ওই সভায় বিশ্ব–ঐতিহ্য কমিটির কাছে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য সুপারিশ হিসেবে ১০৪ পৃষ্ঠার খসড়াটি উপস্থাপন করা হবে। সেখানে সুন্দরবনের বিশ্ব–ঐতিহ্য রক্ষায় বাংলাদেশ সরকারের দেওয়া প্রতিবেদন, বিশ্ব–ঐতিহ্য কমিটির পর্যালোচনা নিয়ে আলোচনা হবে।

১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ সরকারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সুন্দরবনকে বিশ্ব–ঐতিহ্যের সম্মান দেয় ইউনেসকো। কিন্তু তাতে শর্ত ছিল এই বনের জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি হয় এমন কোনো তৎপরতা চালানো যাবে না। শর্ত লঙ্ঘনের কারণে সুন্দরবনের ক্ষতি হলে তার বিশ্ব–ঐতিহ্যের সম্মান চলে যাবে।

সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক সুলতানা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ বিশ্ব–ঐতিহ্য হিসেবে সুন্দরবনের সম্মান ধরে রাখতে বেশ কিছু নিয়ম ও শর্ত পালনের অঙ্গীকার করেছিল। সেগুলো লঙ্ঘন হলে এবং সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সম্পদের অপূরণীয় ক্ষতি হলে সেই সম্মান আর থাকবে না, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এটা একই সঙ্গে দুঃখজনক।

তবে এখনো সময় শেষ হয়ে যায়নি বলেই মনে করেন সুলতানা কামাল। তিনি বলেন, সরকারের উচিত বিশ্ব–ঐতিহ্য কমিটির সভায় রামপালসহ সুন্দরবনের চারপাশের শিল্পকারখানাগুলো বাতিলের বিষয়ে নতুন করে অঙ্গীকার করা। একই সঙ্গে সুন্দরবন রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া।

সুন্দরবন নিয়ে ইউনেসকোর বর্তমান অবস্থানের সঙ্গে একমত নন সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র সুন্দরবন থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে। আর বিশ্বের অনেক দেশেই বনের পাশে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পর্যন্ত রয়েছে। সেখানে কোনো দিন বনের ক্ষতি হয়নি। সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, সুন্দরবনের বিশ্ব–ঐতিহ্যের সম্মান ধরে রাখতে সরকার যুক্তি তুলে ধরবে।

বিশ্ব–ঐতিহ্য কমিটির পর্যালোচনায় বলা হয়, বাংলাদেশ সরকার গত বছরের ৪ ডিসেম্বর ইউনেসকোর কাছে সুন্দরবন রক্ষায় নেওয়া উদ্যোগগুলো চিহ্নিত করে একটি প্রতিবেদন দেয়। তাতে বলা হয়, সুন্দরবনের চারপাশে কোনো শিল্পকারখানার অনুমোদন দেওয়া হয়নি। সুন্দরবনসহ বাংলাদেশের দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলের জন্য ২০৪১ সাল পর্যন্ত একটি কৌশলগত পরিবেশ সমীক্ষা প্রতিবেদন করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে সরকার। সুন্দরবনে মিষ্টি পানির প্রবাহ বাড়াতে গড়াই নদ খননের উদ্যোগ নিয়েছে। এ ছাড়া সুন্দরবন রক্ষায় বাংলাদেশ ও ভারত যৌথ উদ্যোগ নিয়েছে। একই সঙ্গে বাঘ রক্ষায় একটি কর্মপরিকল্পনাও তৈরি করেছে।

সরকারের প্রতিবেদন সম্পর্কে বিশ্ব–ঐতিহ্য কমিটির পর্যালোচনায় বলা হয়, বাংলাদেশ বলেছিল কৌশলগত পরিবেশ সমীক্ষার আগে সুন্দরবনের পাশে কোনো শিল্পকারখানা স্থাপনের অনুমতি দেবে না। ইউনেসকোর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাংলাদেশ রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণকাজ বন্ধ করেনি। গত বছরের এপ্রিলে সরকার সুন্দরবনের চারপাশের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে ১৯০টি শিল্পকারখানার অনুমোদন দিয়েছে। প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন (ইসিএ) হিসেবে চিহ্নিত ওই এলাকায় ১৫৪টি শিল্পকারখানা চালু রয়েছে।