কিশোরী গৃহকর্মীরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে

গৃহকর্মীদের মধ্যে কিশোর-কিশোরীরাই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে। গৃহকর্ম করতে গিয়ে ১৩ থেকে ১৮ বছরের বয়সীরাই মূলত হত্যা ও ধর্ষণের শিকার হয়। এ বয়সীদের মধ্যে আত্মহত্যার হারও বেশি। মেয়েশিশুরাই মূলত গৃহকর্মীর কাজ করে।

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) ২০১৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বছরওয়ারি পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে এই তথ্য পাওয়া গেছে। আটটি জাতীয় দৈনিক সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে এ তথ্য রাখে সংস্থাটি। এতে দেখা যায়, হত্যার শিকার গৃহকর্মীদের ৫৭ শতাংশের বয়স ১৩ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে। এই চার বছরের খুন হয়েছে মোট ৮৭ জন। ধর্ষণের ক্ষেত্রেও একই প্রবণতা দেখা গেছে।

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের পরিচালক মো. আবদুস শহীদ এর কারণ হিসেবে প্রথম আলোকে বলেন, গৃহকর্মী হিসেবে নিয়োজিতদের মধ্যে এই বয়সীদের সংখ্যা বেশি। পাশাপাশি এই বয়স থেকে শিশুরা নিজস্ব মতামত দিতে শুরু করে, অন্যায়ের প্রতিবাদ করে। ফলে তারা যেমন নির্যাতনের শিকার হয়, তেমনি প্রতিবাদ করতে গিয়ে অথবা অপরাধ প্রকাশের ঝুঁকির কারণে খুনের শিকারও হয়। তবে আইনি সুরক্ষা না থাকাই এর বড় কারণ।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) বয়সভিত্তিক গৃহশ্রমিক দুর্ঘটনা ও নির্যাতনের পরিসংখ্যানেও এমন প্রবণতা দেখা গেছে। বিলসের তথ্য বলছে, নির্যাতনের শিকার গৃহকর্মীদের ৭৮ শতাংশই শিশু।

রাজধানীর উত্তরায় গত ২৬ মার্চ বৈশাখী (১২) নামে এক শিশু গৃহকর্মীর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। গলায় ফাঁস লাগা অবস্থায় তার মৃতদেহ পাওয়া যায়। পরিবারের দাবি, বৈশাখীকে হত্যা করে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। মৃত্যুর খবরে বিক্ষোভও করেছে স্থানীয় বাসিন্দারা।

আসকের তথ্য বলছে, ১৩ থেকে ১৮ বছরের শিশুরাই আত্মহত্যা করে বেশি, এর হার ৫৮ শতাংশ। তবে নির্যাতনের কারণে গৃহকর্মীদের মৃত্যু হলেও ‘আত্মহত্যা’ বা ‘দুর্ঘটনায় মৃত্যু’ বলে চালিয়ে দেওয়া হয় বলে জানায় বিলস। অবশ্য ছোট শিশুরা অর্থাৎ সাত থকে ১২ বছরের শিশুরা মারধরের শিকার হয় বেশি।

অথচ গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি ২০১৫ অনুযায়ী, ১৪ বছরের নিচে শিশুদের গৃহকর্মে নিয়োজিত করা যাবে না। তবে ১২ থেকে ১৪ বছরের শিশুরা হালকা কাজ করতে পারবে। কিন্তু নীতিমালায় হালকা কাজের কোনো সংজ্ঞা নেই।


ঝুঁকিপূর্ণ কাজ, স্বীকৃতি নেই

বিলসের তথ্য অনুযায়ী, শ্রমিক নির্যাতনের দিক থেকে পঞ্চম অবস্থায় আছে গৃহশ্রমিকেরা। মৎস্য, পরিবহন, পোশাক শিল্প, কৃষির পরেই এর অবস্থান। আবার, শিশুরাই মূলত গৃহশ্রমিক হিসেবে কাজ করে। কিন্তু শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ৩৮টি ঝুঁকিপূর্ণ কাজের তালিকায় নেই গৃহকর্ম।

বিএসএএফ কর্তৃক পরিচালিত ‘হিডেন স্লেভারি: চাইল্ড ডোমেস্টিক ওয়ার্কার্স’ শীর্ষক এক গবেষণায় দেখা গেছে, শিশু গৃহকর্মীদের ৮৩ শতাংশই মেয়েশিশু। আর এদের প্রায় ৬০ শতাংশ শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার। আর যৌন হয়রানির শিকার ২০ শতাংশ মেয়েশিশু। ২০১৫ সালে ঢাকা বাদে ১০টি শহরে গবেষণাটি পরিচালিত হয়। শ্রম ও কর্মস্থান মন্ত্রণালয় বলছে, গৃহকর্মীদের ৯০ শতাংশ নারী।

গৃহকাজে খুন, ধর্ষণ, যৌন ও মানসিক নির্যাতনের ঝুঁকি উদ্বেগজনক জানিয়ে মানবাধিকার কর্মী ও আইনজীবী সালমা আলী বলেন, ঝুঁকি থাকলেও ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় নেই গৃহকর্ম। বারবার ঝুঁকিপূর্ণ কাজের তালিকায় গৃহকর্ম অন্তর্ভুক্তির দাবি জানিয়ে কাজ হচ্ছে না। শ্রম আইন, শিশু আইনেও তাদের সুরক্ষায় তেমন ব্যবস্থা নেই। তাই গৃহশ্রমিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটছেই।

এ বিষয়ে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের শ্রম অণুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. রেজাউল হক বলেন, প্রয়োজন ও চাহিদার ভিত্তিতে গৃহকর্মীদের সুরক্ষায় নীতিমালা হয়েছে। দরকার হলে ঝুঁকিপূর্ণ কাজের তালিকায় গৃহকর্ম অন্তর্ভুক্ত হবে।