বাংলাদেশের পাটপাতার চা এখন জার্মানিতে

ইন্টারট্রোপের প্রকল্প ব্যবস্থাপনা পরামর্শক মিজানুর রহমান
ইন্টারট্রোপের প্রকল্প ব্যবস্থাপনা পরামর্শক মিজানুর রহমান

কাকভোরে ঘুম ভেঙে ঢুলো ঢুলো চোখে অফিসে ঢুকে, অলস দুপুরে বা বিকেলের আড্ডায় এক কাপ চা যেন প্রাণদায়িনী। চা-প্রেমিক শৌখিন মানুষের জন্য চা প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলোর চেষ্টারও শেষ নেই। ফল, ফুল বা মরিচের স্বাদ—কী নেই ফ্লেভারের নামে! তবে এবার ফ্লেভার নয়, এসেছে পাটপাতার চা। গরম ভাতে পাটশাকের স্বাদের যেমন তুলনা নেই, এ পাতার গুণাগুণেরও শেষ নেই।

দেশীয় বাজারে পাটপাতার চা বহুল প্রচলিত না হলেও এই চা পৌঁছে গেছে ইউরোপের বাজারে। জার্মানিভিত্তিক একটি স্টার্টআপ ‘ইন্টারট্রোপ’ সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে দুই টন পাটপাতার চা নিয়েছে। জার্মানিপ্রবাসী বাংলাদেশি উদ্যোক্তা মিজানুর রহমান দুজন জার্মানের সঙ্গে মিলে গড়ে তুলেছেন প্রতিষ্ঠানটি।

পাট মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের সহযোগিতায় ও উদ্যোগে ‘ইন্টারট্রোপ’ জার্মানিতে চা নেওয়ার এই প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এর অংশ হিসেবে মানিকগঞ্জের লেমুবাড়িতে সাড়ে সাত হেক্টর জমিতে ইতিমধ্যে চাষ করা হয়েছে অরগানিক পাট।

ভেষজ গুণে সমৃদ্ধ পাটের চায়ে আছে খনিজ এবং নানান পদের ভিটামিনের সমাহার। এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ওমেগা-৩–সহ অনেক উপাদান, যা মানবদেহের জন্য ভীষণ উপকারী। ডায়বেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদ্‌রোগ ঠেকাতে উপকারী এই পানীয়।

কথা হচ্ছিল ইন্টারট্রোপের উদ্যোক্তাদের একজন মিজানুর রহমানের সঙ্গে। প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি তাঁর প্রতিষ্ঠান এবং পাটের চা রপ্তানির উদ্যোগ নিয়ে কথা বলেন।

রংপুরের ছেলে মিজানুর বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। জার্মানির হোহেনহেইম বিশ্ববিদ্যালয়ে যান স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিতে। ‘চাইলেই বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে মোটা মাইনের চাকরি করতে পারতাম। কিন্তু নিজের কিছু একটা করার ইচ্ছেটা ছিল প্রবল,’ হাসিমুখে বলেন মিজানুর। মিজানুরের কথায়, শুরুটা হয়েছিল এক সন্ধ্যায় আরেক সহপ্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান বোরনারের সঙ্গে আড্ডায়। তারপর দেখা মেলে জুলিয়ান কোফলারের। তিনজনে সিদ্ধান্ত নেন নিজেদের মতো করে কিছু করার। রাতারাতি বিল গেটস বনে যাবেন, এমন কোনো উচ্চাশা ছিল না তাঁদের। স্বপ্ন ছিল একটু আলাদা কিছু করার, যাতে আর্থিক সচ্ছলতা ছাড়াও কল্যাণমূলক কিছুও থাকে। এশিয়া ও আফ্রিকার ট্রপিক্যাল দেশগুলোর নিজস্ব পণ্য ইউরোপের বাজারে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রাথমিক পরিকল্পনা নিয়ে শুরু হয় ‘ইন্টারট্রোপ’।

বাংলাদেশি হিসেবে পাটের কথাই প্রথমে মাথায় আসে মিজানুরের। পাঠের ব্যাগ ও অন্যান্য পাটজাত পণ্য দিয়ে যাত্রা শুরু হয়। গল্পের ছলে বললেন, ‘২০১৫ সালে আমি আর জুলিয়ান একবার বাংলাদেশে আসি। সে সময় গাজীপুরে পাটজাত পণ্যের খোঁজে যাই আমরা। দুপুরের খাবারের মেন্যু ছিল অতি সাধারণ বাঙালি খাবার—ডাল, ভাত আর পাটশাক। পাটপাতা সবজি হিসেবে খাওয়া যায় দেখে বেশ অভিভূত হন জুলিয়ান।’

এরপর প্রস্তাব আসে জুলিয়ানে পক্ষ থেকে। তাঁর ভাষায়, জার্মানরা হয়তো সবজি হিসেবে পাটপাতা খাবে না; তবে অন্য কোনো উপায়ে খাওয়া গেলে মন্দ হবে না। ঠিক সেবারই ঢাকায় পাট উৎসবে দেখা হয় ইসমাইল হোসেন খানের সঙ্গে। তাঁর সঙ্গে পাটপাতার চা নিয়ে আলোচনা হয়। তিনি তখন বাংলাদেশে পাটপাতার চা বাজারজাতকরণে কাজ করছেন। ব্যস! সেই থেকে শুরু। প্রসঙ্গত, ইসমাইল হোসেন খান বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের অধীনে পাটপাতার চা প্রকল্পের উপদেষ্টা। এর তিন মাস পর ইসমাইল খান ইন্টারট্রোপের অনুরোধে ১৬ কেজি নমুনা চা–পাতা পাঠান জার্মানিতে। প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে যাত্রা শুরু করে ‘জুট-টি’।

ইন্টারট্রোপের বাজারজাতকৃত ‘জুট-টি’
ইন্টারট্রোপের বাজারজাতকৃত ‘জুট-টি’

জার্মানির বাজারে এ রকম একটি পণ্যের যাত্রা সহজ ছিল কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে মিজানুর বলেন, ‘একেবারে মসৃণ যে ছিল না, তা বলাই বাহুল্য। ইউরোপের বাজারে নতুন কোনো খাদ্যপণ্য চালু করতে খরচ হয় ২০ হাজার ইউরো। সৌভাগ্যবশত, আমরা জানতে পারি ১৯৯৬ সালের আগে গ্রিসে পাটপাতার ব্যবহার হয়েছে। আর কী লাগে! আমরা ওই রেফারেন্স ব্যবহার করে জার্মান কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে ছাড় করিয়ে নিলাম পাটপাতার চায়ের।’

ইন্টারট্রোপ প্রাথমিকভাবে পাটপাতার চা ওষুধের দোকানগুলোয় বিক্রি করার উদ্যোগ নিয়েছে। ভেষজ চায়ের বেশ কদর থাকায় জার্মানির বাজার নিয়ে বেশ আশাবাদী এর সহপ্রতিষ্ঠাতা ও ইন্টারট্রোপের প্রকল্প ব্যবস্থাপনা পরামর্শক মিজানুর রহমান।

পাটের এই চায়ের ধরনেও রয়েছে অনেক বৈচিত্র্য। পাঁচটি আলাদা স্বাদে ‘জুট-টি’ বাজারজাত করেছে তারা। জার্মানির বিশাল বাজারে অন্তত শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ জায়গা করে নেওয়ার প্রাথমিক পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে ইন্টারট্রোপ, জানালেন মিজানুর।

দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে এগোলে এই প্রকল্পের অপার সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করে মিজানুর বলেন, শুধু সরকারিভাবে চা রপ্তানি নয়, এই প্রকল্পের মাধ্যমে দেশে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ হতে পারে। একে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতে পারে নানা ধরনের ছোট ও বড় প্রতিষ্ঠান। যেমন: উৎপাদন, প্যাকেজিং, পরিবহনসহ অনেক কিছু। আর এসব সম্ভাবনা কাজে লাগাতে অরগানিক পাট উৎপাদন, গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য আরও সরকারি সহায়তা প্রয়োজন বলে মত তাঁর।

‘আত্মপ্রচারের ইচ্ছা কম। তাই গণমাধ্যমে কম এসেছি। আমি খুশি নিজের মতো কিছু করতে পেরে। আর “জুট-টি”-এর প্যাকেটে যখন “মেইড ইন বাংলাদেশ” লেখা দেখি, ভীষণ গর্ববোধ করি,’ তৃপ্ত অথচ স্বপ্নমাখা চোখ নিয়ে আলাপ শেষ করলেন মিজানুর রহমান।