চট্টগ্রাম ওয়াসার ৩৮% গ্রাহক ৫ গুণ বেশি বিল দেন

মাসে ব্যবহার করেন পাঁচ ইউনিট পানি (এক ইউনিটে এক হাজার লিটার)। কিন্তু বিল দেন ৩০ ইউনিটের। যা ব্যবহারের পাঁচ গুণ বেশি। মাসের পর মাস এই বাড়তি বিল দিয়ে আসছেন চট্টগ্রাম ওয়াসার ২৭ হাজার গ্রাহক। যা ওয়াসার মোট গ্রাহকের ৩৮ শতাংশ।

‘গড় বিল পদ্ধতি’–এর নামে গ্রাহকদের কাছ থেকে এভাবে বাড়তি বিল আদায় করে যাচ্ছে সেবা সংস্থাটি। ‘সিস্টেম লস’ কমানো এবং ‘রাজস্ব আয়’ বাড়ানোর জন্য মূলত এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা হচ্ছে।

গ্রাহকদের কাছ থেকে এই পদ্ধতিতে অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার কারণে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন খোদ সংস্থাটির বোর্ড সদস্যরা। গ্রাহক হয়রানিসহ এসব অনিয়মের তদন্তের জন্য তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে।

গত ২৫ মে ওয়াসার ৫১তম বোর্ড সভায় সংস্থাটির অর্থ বিভাগ তাদের প্রতিবেদন তুলে ধরে। প্রতিবেদনে বিশালসংখ্যক এই গ্রাহকের কাছ থেকে অতিরিক্ত বিল নেওয়ার বিষয়টি উঠে আসে।

ওয়াসা সূত্র জানায়, ওয়াসার গ্রাহক রয়েছেন ৭১ হাজার ১৩০ জন। এদের মধ্যে ৬৪ হাজার ১৯ জন আবাসিক গ্রাহক। বাকি ৭ হাজার ১১১ জন অনাবাসিক। সে হিসাবে ২৭ হাজার গ্রাহক মানে তা মোট গ্রাহকের প্রায় ৩৮ শতাংশ।

ওয়াসা সূত্র জানায়, আগে ব্যবহার না করলেও প্রতিদিন ০ দশমিক ৭৮ ইউনিট হিসাবে গ্রাহককে বিল দিতে হতো। তিন–চার মাস আগে সেই সিদ্ধান্তে বদল আনা হয়। এখন প্রতিদিন এক ইউনিট হিসাবে বিল দিতে হচ্ছে গ্রাহককে।

প্রায় প্রতিদিনই ওয়াসার অভিযোগ কেন্দ্রে এবং রাজস্ব কার্যালয়ে গ্রাহকদের ভিড় দেখা যায়। তাঁদের বেশির ভাগই আসেন অতিরিক্ত বিলের বিষয়ে অভিযোগ জানাতে। গত রোববার ওয়াসা কার্যালয়ে এমন পাঁচজন গ্রাহকের সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। তাঁরা বলেন, তাঁদের মিটার ঠিক আছে। কিন্তু ওয়াসার ‘মিটার রিডার’ মিটার না দেখেই বিল তৈরি করেন। এর ফলে তাদের প্রতি মাসে অতিরিক্ত বিল দিয়ে যেতে হচ্ছে।

গড় বিল’–এর পেছনে যে উদ্দেশ্য

ওয়াসার বর্তমানে সিস্টেম লস (রাজস্ববহির্ভূত পানি) ৩০ শতাংশ। মাঝেমধ্যে এটি আরও বাড়ে। উৎপাদনের প্রায় ৩০ শতাংশ পানি নষ্ট হওয়া নিয়ে ওয়াসা প্রশাসন অস্বস্তিতে আছে। প্রায় প্রতি বোর্ড সভাতেই সিস্টেম লস কমানোর তাগাদা দেন বোর্ড সদস্যরা।

৫১তম বোর্ড সভায় অর্থ বিভাগের দেওয়া প্রতিবেদনে বলা হয়, ২৭ হাজার গ্রাহক অতিরিক্ত বিল দেওয়ায় এখন সিস্টেম লস হচ্ছে ৩০ শতাংশ। তাঁরা যদি নির্ধারিত বিল দিতেন তাহলে এই লস ৫০ শতাংশ ছাড়িয়ে যেত।

ওয়াসার অর্থ বিভাগ থেকে জানা যায়, অতিরিক্ত বিল দেওয়া ২৭ হাজার গ্রাহকই আবাসিক। বর্তমানে আবাসিক গ্রাহকদের প্রতি ইউনিট পানির দাম ৯ টাকা ৯২ পয়সায় বিক্রি করছে ওয়াসা। সে হিসাবে দেখা যায়, গ্রাহকদের কাছ থেকে ৬ লাখ ৭৫ হাজার ইউনিটের বিল বেশি রাখা হচ্ছে। টাকার অঙ্কে হিসাব করলে যা দাঁড়ায় প্রতি মাসে ৬৬ লাখ ৯৬ হাজার টাকা।

>
  • গড় বিল পদ্ধতির নামে গ্রাহকদের কাছ থেকে বাড়তি বিল আদায়
  • গ্রাহকেরা ক্ষুব্ধ
  • অনিয়ম তদন্তের জন্য তিন সদস্যের কমিটি

উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (অর্থ) নুরুল আলম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘গড় বিল পদ্ধতির কারণে এটা হচ্ছে। যেসব গ্রাহকের মিটার নষ্ট বা চুরি হয়ে গেছে সেসব গ্রাহকের অতিরিক্ত বিল আসছে। আমরা চাচ্ছি এই গ্রাহকদের নতুন মিটার দিয়ে নির্দিষ্ট বিল পদ্ধতির মধ্যে নিয়ে আসতে। তবে এ জন্য কিছুটা সময় লাগছে।’ তিনি যেসব গ্রাহকের মিটারের সমস্যা রয়েছে তাঁদের নতুন মিটার সংগ্রহ করার অনুরোধ জানান।

ওয়াসা বোর্ড গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান জাফর আহমেদ সাদেক প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা সব বিষয় তদন্ত করছেন। ভোগান্তি জানতে গ্রাহকদের ঘরে ঘরে যাচ্ছেন। এরপর প্রতিবেদন জমা দেবেন।

ক্রেতা-ভোক্তাদের স্বার্থ সংরক্ষণকারী জাতীয় প্রতিষ্ঠান কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, অনেক দিন ধরেই গড় বিলের মাধ্যমে গ্রাহক হয়রানির অভিযোগ ওয়াসার কাছে করে আসলেও তারা অস্বীকার করছে। এখন বোর্ড সভায় বিষয়টি ওঠায় প্রমাণিত হলো অভিযোগই সঠিক। এ জন্য ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ সংশ্লিষ্ট সবার শাস্তি হওয়া উচিত। তাঁরা নৈতিকভাবে আর পদেও থাকতে পারেন না।