মুক্তিযুদ্ধে হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিতে গিয়ে কাঁদলেন স্বজনেরা

যুদ্ধ তখন শুরু হয়ে গেছে। স্থানীয় রাজাকারেরা পাকিস্তানি বাহিনীকে নিয়ে গ্রামে ঢোকে। টের পেয়ে আগেই শিশু ও নারীদের সরিয়ে পার্শ্ববর্তী হাওরের ঝোপে নিয়ে লুকিয়ে রাখা হয়। পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা বাড়ি বাড়ি গিয়ে লুটপাট চালায়। পুরুষ সদস্যদের ধরে একটি পুকুরপাড়ে নিয়ে দাঁড় করায়। এরপর তালিকায় নাম থাকা তিনজনকে রেখে অন্যদের চলে যেতে বলে। কিছু সময় পরই পাকিস্তানি বাহিনীর আগ্নেয়াস্ত্র গর্জে ওঠে। মাটিতে লুটিয়ে পড়েন ওই তিনজন। ঘটনাস্থলেই দুজন মারা যান। গুলিবিদ্ধ হলেও বেঁচে যান অপর ব্যক্তি।

গতকাল সোমবার মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিটি) তদন্ত দলের কর্মকর্তাদের কাছে সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দেন স্বজনেরা। হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিতে গিয়ে তাঁরা কেঁদে ফেলেন।

তদন্ত দল সূত্রে জানা গেছে, যুদ্ধাপরাধের বিষয়ে অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত বিভাগের সদস্য সহকারী পুলিশ সুপার শাহজাহান কবীরের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি দল মৌলভীবাজারের বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিন তদন্ত করছে। গতকাল সকাল ১০টার দিকে জুড়ী উপজেলা পরিষদের সভাকক্ষে তদন্ত শুরু হয়। এ সময় মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পশ্চিম জুড়ী ইউনিয়নের খাকটেকা (বড়বাড়ি) গ্রামের বাসিন্দা রাজকিশোর দাস ও পার্শ্ববর্তী বড়লেখা উপজেলার সুজানগর ইউনিয়নের সালদিঘা গ্রামের রাজেন্দ্র কুমার দাসের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে তাঁদের স্বজন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, মুক্তিযোদ্ধা এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করা হয়।

শহীদ রাজকিশোর দাসের ভাগনে অনুকূল দাস (৭০) বলেন, দিনটি ছিল ১৯৭১ সালের ২১ মে। সকাল সাড়ে নয়টার দিকে পাকিস্তানি বাহিনীর স্থানীয় সুজানগর ক্যাম্পের কর্মকর্তা মেজর আজম খানের নেতৃত্বে শত্রুপক্ষের লোকজন সশস্ত্র অবস্থায় তাঁদের এলাকায় আসে। এ সময় পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে তাদের দোসর সালদিঘা গ্রামের বাসিন্দা মৃত আবদুল লতিফ, মইজ উদ্দিন, ময়না মিয়া ও খাকটেকা গ্রামের অশ্বিনী দাস ছিলেন। এর আগে পাকিস্তানি বাহিনী পাশের সালদিঘা গ্রামে তাণ্ডব চালায়। সেখান থেকে তারা রাজেন্দ্র দাস ও তাঁর ছেলে গীতা রঞ্জন দাসকে ধরে আনে। পরে খাকটেকার প্রায় ১০০ জন বিভিন্ন বয়সী লোককে বাড়ি থেকে ধরে এনে নরেন্দ্র দাসের বাড়ির পুকুরপাড়ে নিয়ে জড়ো করে। একপর্যায়ে রাজাকার লতিফ তালিকা বের করে রাজেন্দ্র, গীতা ও রাজকিশোর বাদে অন্যদের চলে যেতে বলেন। ওই তিনজন আওয়ামী লীগের রাজনীতি করতেন। পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করতেন। এর কিছু সময় পরই তিনজনকে চোখ বেঁধে গুলি করা হয়। পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা চলে যাওয়ার পর রাজেন্দ্র ও রাজকিশোরকে নিথর অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল পুকুরপাড়ের সবুজ ঘাস। গীতা রঞ্জন যন্ত্রণায় ছটফট করছিলেন। তাঁর বুকে গুলি লাগে। স্বজনদের কাছে খবর পাঠানো হয়। তাঁরা এসে আহত অবস্থায় গীতাকে উদ্ধার করে বাড়ি নিয়ে যান।

সেদিনের দৃশ্য আজও তাড়া করে বেড়ায় অনুকূল দাসকে। পাকিস্তানি বাহিনী চলে যাওয়ার পর তিনিসহ অন্যরা হাওরে লুকিয়ে রাখা শিশু ও নারীদের বাড়ি নিয়ে আসেন। উপোস অবস্থায় ওই দিনই তাঁদের নিয়ে ভারতের উদ্দেশে রওনা দেন। সেখানে শরণার্থী হিসেবে তাঁরা আশ্রয় নেন। সেই দলে ছিলেন আহত গীতা রঞ্জনও।

শহীদ রাজেন্দ্র দাসের ছেলে ও গীতার ছোট ভাই বিপুল কান্তি দাস বলেন, ভারতে বেশ কিছু দিন চিকিৎসার পর গীতা সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন। ২০১৫ সালের ২১ ডিসেম্বর তিনি পরপারে পাড়ি জমান। গীতার জীবদ্দশায় শহীদ পরিবারের স্বীকৃতি পেতে তাঁদের পরিবারের পক্ষ থেকে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে আবেদন করা হয়েছিল। কিন্তু তা জোটেনি। ভাইয়ের মৃত্যুর পর সে আশা ছেড়ে দিয়েছেন।

তদন্ত দলের প্রধান শাহজাহান কবীর প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা তথ্য সংগ্রহ করছি। সেগুলো ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করা হবে। ট্রাইব্যুনাল এ বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে।’