অনিয়মের উপজেলায় নিয়মের ভোট

কটিয়াদী উপজেলার প্রাণকেন্দ্র বাসস্ট্যান্ডের পাশের নির্বাচনী কেন্দ্র এটি। অথচ ভোট গ্রহণ শুরুর প্রায় পৌনে দুই ঘণ্টা পর বেলা পৌনে ১১টার দিকে ফাঁকা কেন্দ্রে শুধু দুই সংবাদকর্মীকে মুঠোফোনে ছবি ধারণ করতে দেখা যাচ্ছে। পাশে একজন নিরাপত্তাকর্মী বসে আছেন। কটিয়াদী ২ নং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠ। ছবি: তাফসিলুল আজিজ
কটিয়াদী উপজেলার প্রাণকেন্দ্র বাসস্ট্যান্ডের পাশের নির্বাচনী কেন্দ্র এটি। অথচ ভোট গ্রহণ শুরুর প্রায় পৌনে দুই ঘণ্টা পর বেলা পৌনে ১১টার দিকে ফাঁকা কেন্দ্রে শুধু দুই সংবাদকর্মীকে মুঠোফোনে ছবি ধারণ করতে দেখা যাচ্ছে। পাশে একজন নিরাপত্তাকর্মী বসে আছেন। কটিয়াদী ২ নং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠ। ছবি: তাফসিলুল আজিজ

তখন বেলা প্রায় সাড়ে ১১টা। কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার চরিয়াকোনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের ভেতর ও বাইরে নীরবতা। কেন্দ্রের ভেতরে ভোটের সারি নেই। বাইরে নেই ভোটার কিংবা প্রার্থীর সমর্থকদের জটলা। ওই সময়ে কেন্দ্রটির ৮ নম্বর বুথে ভোট দিয়েছেন মাত্র পাঁচজন। পুরো কেন্দ্রে ভোট প্রদান হার ছিল ১০ শতাংশ।

ভোট দেওয়ার হার কম হলেও পরিবেশ ছিল পরিচ্ছন্ন। ভোটাররাও শৃঙ্খলা মেনে এবং শান্ত থেকে স্বাভাবিক নিয়মে ভোট দিয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত উপজেলার ৮৯টি কেন্দ্রের কোথাও বিচ্ছিন্ন একটি অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটার খবর পাওয়া যায়নি। প্রার্থীদের পক্ষ থেকেও কোনো অভিযোগ নেই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও ভোট গ্রহণসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা স্বাভাবিকভাবেই দিনটি পার করে দিতে পেরেছেন।
অথচ গত ২৪ মার্চের নির্বাচনে রাতেই নৌকার সমর্থকেরা কয়েকটি কেন্দ্রের ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নিয়ে বাক্সভর্তি করে রাখেন-—প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের কাছ থেকে এমন অভিযোগ পাওয়ার পর ভোট গ্রহণ স্থগিত করে দেয় নির্বাচন কমিশন। এরপর থেকে উপজেলাটিতে শুষ্ঠু ভোট নিয়ে শঙ্কা পেয়ে বসেছিল দলটির বিদ্রোহী প্রার্থীদের মধ্যে। আস্থাহীনতা কাজ করেছে ভোটারদের মধ্যে। দুই মাস ২৫ দিনের ব্যবধানে একই নির্বাচনের নির্বাচনী পরিবেশের বিপরীত চিত্র দেখে অনেকের মূল্যায়ন ছিল এই যেন অনিয়মের উপজেলায় হয়েছে নিয়মের ভোট।

কেন্দ্রটিতে ভোট দিতে পেরে বেশ গর্ব অনুভব করেন চরিয়াকোনা গ্রামের গৃহবধূ হেনা রানী পাল। হেনা বলেন, ‘আগের নির্বাচনে (২৪ মার্চ) ভোট দিতে আইয়া হুনি ভোট হইয়া গেছে। আর আইজ কী সুন্দর পরিবেশ। কোনো ঝামেলা নাই। আমার ভোট আমি দিতে পারছি। আওয়া যাওয়ার পথে কেউ কিছু বলেও নাই।’

সকাল থেকে শেষ পর্যন্ত উপজেলাটির ১৬টি কেন্দ্র ঘুরে ভোটারদের এমন অভিব্যক্তিই পাওয়া গেছে। কোনো কেন্দ্রে ছিল না ভোটের সারি। কিছু সময় বিরতির পর একজন–দুইজন করে ভোটার আসছেন এবং ভোট দিয়ে চলে যাচ্ছেন। কম ভোটার উপস্থিতির মধ্যে আরও কম কেন্দ্রমুখী হয়েছেন নারী ভোটাররা।

কটিয়াদী ২ নম্বর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে মোট ভোটার ২ হাজার ২০৩ জন। সকাল ১০টা ৫০ মিনিটে ওই কেন্দ্রে গিয়ে জানা যায় ভোট দিয়েছেন ১৬২ জন। ওই কেন্দ্রে গিয়ে দেখা হয় আওয়ামী লীগের ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী আলী আকবরের সঙ্গে। ভোটার কম হওয়া নিয়ে হতাশা থাকলেও নির্বাচনী পরিবেশ নিয়ে তিনি স্বস্তি প্রকাশ করেন।

৩৩ নম্বর চাতাল বাগহাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র ও চাতালবাগ উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্র দুটির অবস্থান একই সীমানাপ্রাচীরের ভেতর। ২৪ মার্চ যে কটি কেন্দ্রে গোলযোগ হয়েছে, এর মধ্যে এই দুটি কেন্দ্রও রয়েছে। বেলা দেড়টার দিকে গিয়ে দেখা যায় ভোটকেন্দ্র জনশূন্য। তখন পর্যন্ত চাতালবাগ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ১ হাজার ৯৪১ ভোটের বিপরীতে ভোট পড়েছে ১০০টি। আর চাতালবাগ উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে ১ হাজার ৮৯৭ ভোটের বিপরীতে ভোট দিয়েছেন ৩৫০জন।
চাতালবাগ উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা মোহাইমিনুল ইসলাম বলেন, ‘ভোটারদের মানসিকতার পরিবর্তন দেখে আমি মুগ্ধ। কোনো ভোটারের মুখে বাড়তি শব্দ নেই। কাগজ নিয়ে আসছেন। ভোট দিচ্ছেন আর চলে যাচ্ছেন। ভোট পরিচালনা করতে এতটুকু বেগ পেতে হয়নি।’
বোয়ালিয়ার তাহেরা নূর হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজ, জালালপুর উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্র, লোহাজুড়ি ইউনিয়ন উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্র, বেতাল বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে শান্ত ও স্বাভাবিক পরিবেশ লক্ষ করা গেছে। তবে দুপুর ১২টার দিকে আচমিতা ২ নম্বর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে কেন্দ্রটির সাতটি বুথে ভোট দেওয়ার জায়গায় পর্দা পাওয়া যায়নি। কিছু সময় পর ওই কেন্দ্রে আসেন বিচারিক হাকিম রফিকুল বারী। তিনি তখন এই বিষয়ে প্রিসাইডিং কর্মকর্তার কাছে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। পরে অবশ্য পর্দার ব্যবস্থা করা হয়।
দলটির আরেক বিদ্রোহী মুশতাকুর রহমান বলেন, সুষ্ঠু ভোট নিয়ে অভিযোগ নেই। তবে ভোটাররা কেন কেন্দ্রমুখী হননি, তা ভেবে দেখা দরকার।

নৌকার প্রার্থী তানিয়া সুলতানাও ‘ভোট ভালো হচ্ছে’ বলে মন্তব্য করেন।

ঝামেলবিহীন ভোট সম্পন্ন করতে পেরে বেশ তৃপ্ত রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. তাজুল ইসলাম। তবে কিছুটা হতাশ ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ায়। তাজুল ইসলাম বলেন, প্রাথমিক হিসেবে ধারণা করা হচ্ছে ৩০ ভাগের বেশি ভোট পড়েনি।

ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগে এই উপজেলায় ২৪ মার্চের ভোট স্থগিত হয়ে যায়। ভোটের দিন অনিয়ম ঠেকাতে ব্যর্থ হওয়ায় জেলাটির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) শফিকুল ইসলাম ও কটিয়াদী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শামসুউদ্দীনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন ছয়জন। তাঁরা হলেন নৌকার প্রার্থী কেন্দ্রীয় যুব মহিলা লীগের সহ তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক তানিয়া সুলতানা। আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীরা হলেন উপজেলা বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি আলী আকবর, উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য মুশতাকুর রহমান, উপজেলার সহস্ররাম দুলদিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আলতাফ উদ্দিন। এ ছাড়া জাকের পার্টির কর্মী শহীদুজ্জামান স্বপন এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. আনোয়ার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।

ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন রেজাউল করিম শিকদার, মো. বকুল মিঞা, সদরুল হক, মজিবুর রহমান, মো. কামরুজ্জামান ও আবুল কালাম।
নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়েছেন তিনজন। তাঁরা হলেন সাথী বেগম, রোকসানা ও নওরীন সুলতানা।