সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালক হাসমত হত্যায় আটজনের যাবজ্জীবন

ঢাকায় এক যুগ আগে সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক হাসমত আলী মোল্লাকে (৩৫) হত্যার দায়ে আটজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। আজ বুধবার ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫ এর বিচারক আখতারুজ্জামান এই রায় দেন।

রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক আখতারুজ্জামান বলেছেন, স্বার্থের কারণে যাত্রী কিংবা অটোরিকশার চালককে হত্যা করতে ছিনতাইকারীরা মোটেও দ্বিধাবোধ করে না। এরা মানুষরূপী পশু বা তাঁর চেয়েও নিকৃষ্টতম প্রাণী। হাসমত আলীর হত্যার কাহিনি প্রমাণ করে, ছিনতাইকারীদের কোনো ধর্ম নেই, পেশা নেই, মনুষ্যত্ববোধ নেই। এরা দেশ ও জাতির চরম শত্রু।

যাবজ্জীবন দণ্ড পাওয়া আট আসামি হলেন, স্বপন ওরফে রাজু, জামাল হোসেন, আকবর, শেখ ফরিদ, মিজানুর রহমান, মফিজ শেখ, সেলিম শেখ ও কাদির মোল্লা। এঁদের মধ্যে স্বপন, মিজানুর ও সেলিম ছাড়া সবাই পলাতক। তাঁদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে।

হাসমত হত্যার কাহিনি
রায়ের তথ্য বলছে, হাসমত আলী ঢাকার মিরপুরে মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বসবাস করতেন। সেদিন (২০০৭ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর) হাসমত অটোরিকশা নিয়ে সকালে বাসা থেকে বের হয়ে যান। এরপর রাত ১১টার সময় উচ্চমাধ্যমিক পড়ুয়া ছেলে বাবু মোল্লা ফোনে জানতে পারেন তাঁর বাবা হাসমত মারা গেছেন। লাশ পড়ে আছে ঢাকা মেট্রোপলিটন হাসপাতালে। সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে যান বাবু। দেখেন, তাঁর বাবার দেহে নানা জখম।
বাবু মোল্লা পরদিন ২৬ সেপ্টেম্বর গুলশান থানায় হত্যা মামলা করেন। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) তদন্তে হাসমত হত্যার আসল রহস্য বেরিয়ে আসে। আটজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেন ডিবির পরিদর্শক এস এম শাফিউল আজম।

হাসমতকে কীভাবে, কেন এবং কারা হত্যা করে— তা আদালতের কাছে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বর্ণনা করেন আসামি আবদুল কাদির ও শেখ ফরিদ।

কাদির আদালতকে বলেন, এক সময় তিনি জুরাইন রেললাইন এলাকায় আলু-পিয়াজ বিক্রি করতেন। তখন মফিজ আর সেলিমের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। সেলিম আর মফিজ আগে থেকে অটোরিকশা চুরি করতেন। পরে ওই দলে তিনিও যোগ দেন। একসঙ্গে তাঁরা অটোরিকশা চুরি করেছেন। ঘটনার দিন আকবর তাঁকে ফোন দেন। কারওয়ান বাজারে আসতে বলেন। কারওয়ান বাজারে আসার পর সেলিম, মফিজ, আকবর আর ফরিদের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। তাঁরা সেদিন কারওয়ান বাজারের কাঁচাবাজারের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। সবাই মিলে অটোরিকশা চুরির পরিকল্পনা করেন। এ সময় একজন অটোরিকশা চালক চা পান করার জন্য আসেন। সেলিম তখন (আসামি) চা বিক্রেতার ভূমিকায় ছিলেন। সেলিমের হাতে ছিল ফ্লাস্ক। ফ্লাস্ক থেকে কাপে চা ঢালার সময় নেশাজাতীয় উপাদান তাতে মিশিয়ে দেন সেলিম। সেই চা পান করেন ওই অটোরিকশা চালক। একটু পরে অটোরিকশাচালক (চালক হাসমত) তেজগাঁও সাতরাস্তা এলাকায় চলে যান।

কাদির আদালতকে আরও বলেন, অটোরিকশা চালক চলে যাওয়ার সময় তাঁরাও পিছু নেন। অটোরিকশার নম্বর তাঁরা আগেই টুকে নিয়েছিলেন। সাতরাস্তায় গিয়ে দেখেন, যাত্রী নেওয়ার জন্য ওই চালক অপেক্ষা করছেন। চালক কিছুটা ঝিমাচ্ছিলেন। বিমানবন্দরে যাওয়ার নাম করে ওই অটোরিকশা ভাড়া করেন তাঁরা। তিনি (কাদির), সেলিম আর মফিজ ওই অটোরিকশায় ওঠেন। পেছনে রিকশায় করে আসতে থাকেন অপর আসামি আকবর ও ফরিদ। মহাখালী যাওয়ার আগেই তাঁরা বুঝতে পারেন চালক নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। তখন তাঁরা অটোরিকশা থামাতে বলেন। অটোরিকশা থামালে সেখানে চলে আসেন আকবর ও ফরিদ। তখন রাত বাজে সাড়ে ৮টা। আকবর ওই অটোরিকশা চালাতে শুরু করেন। তিনি (কাদির), সেলিম, মফিজ ও ফরিদ আর ওই চালক পেছনের সিটে বসেন। সেলিম তখন চাকু বের করে চালকের বুকে আঘাত করেন। পরে তাঁকে (হাসমত) মহাখালী উড়াল সড়কের উত্তরপাশে ফেলে দেওয়া হয়।

এ সময় মহাখালী উড়াল সড়ক দিয়ে যাচ্ছিলেন আবু নাজেম নামের একজন। নাজেম আদালতে দেওয়া সাক্ষ্যে বলেন, নিজের গাড়ি চালিয়ে তিনি যাচ্ছিলেন তখন। গাড়ির আলোয় দেখতে পান, এক লোক রাস্তায় গড়াগড়ি দিচ্ছেন। মানবিক কারণে তিনি গাড়ি থামান। তখন পুলিশকে খবর দেওয়া হয়। লোকটির অবস্থায় খারাপ দেখে তাঁকে নিয়ে যান মহাখালীর মেট্রোপলিটন হাসপাতালে। তখন সেখানকার কর্মরত চিকিৎসক লোকটিকে মৃত ঘোষণা করেন।

রায়ে আদালত বলেন, চালক হাসমত আলীর মৃত্যুর কথা প্রমাণ করে যে, ছিনতাইকারীরা সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষকে হত্যা করতে মোটেও কুণ্ঠাবোধ করেন না। এই ছিনতাইকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দিলে মানুষের স্বাভাবিক জীবন নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।

রায়ে আদালত বলেন, কারওয়ান বাজার এলাকা থেকে সাত রাস্তা হয়ে টঙ্গী ডাইভারশন সড়ক দিয়ে বিমানবন্দর যাওয়ার রাস্তাটি অনেকাংশে ছিনতাই প্রবণ এলাকা। সন্ধ্যার পর ওই রাস্তা দিয়ে চলাচল করতে গিয়ে পথচারীরা ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ছে। কখনো কখনো ছিনতাইয়ের সঙ্গে সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালকেরাও জড়িত থাকেন। তখন চালক অটোরিকশাচালক নষ্ট হয়েছে ভান করে নির্জন কোনো স্থানে দাঁড়ান। ওত পেতে থাকা তাঁর সহযোগীরা তখন যাত্রীদের জিম্মি করে সর্বস্ব লুট করে নেয়। বাধা দিলে হত্যা করতে কুণ্ঠাবোধ করে না।

রায়ে আদালত আরও বলেন, ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে অটোরিকশার চালক হাসমত খুন হন। এই অবস্থা চলতে দেওয়া যায় না, কাম্যও নয়। ঢাকা মহানগরসহ বাংলাদেশের অনেক বড় বড় শহরে ছিনতাইকারীরা নিরীহ যাত্রীদের জীবননাশের অহরহ ঘটনা ঘটছে।