ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে মুখ খুলছেন ভুক্তভোগীরা

সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন। ফাইল ছবি
সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন। ফাইল ছবি

পাপ বাপকেও ছাড়ে না। বললেন কলেজছাত্র নুরুল ইসলাম। সোনাগাজীর মনগাজী বাজারে একটি ছোট চায়ের দোকান চালিয়ে পেট চালাতেন তিনি। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের একদিন রাত ১১টায় পৌর শহরের কলেজ রোডে আড্ডা দিচ্ছিলেন নুরুল। আবুল খায়ের নামে এক পুলিশ সদস্য তাঁকে ধরে থানায় নিয়ে ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের সামনে হাজির করেন। হুন্ডি ব্যবসার অভিযোগ এনে তাঁর কাছে ১৫ লাখ টাকা দাবি করেন ওসি।

নুরুল ইসলাম গত সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ওই রাতে তিনি ওসিকে বলেন, কোনো অবৈধ ব্যবসা করেন না। তিনি গরিব ঘরের সন্তান। বাড়ি বিক্রি করলেও এত টাকা দেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব না। ওসি তাঁকে অবৈধ চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত থাকা এবং জামায়াতের মামলায় কারাগারে পাঠানোর হুমকি দেন। দুদিন থানায় আটক থাকার পর পরিবারের সদস্যরা দুই লাখ টাকা ধার করে এক স্থানীয় ব্যক্তির মাধ্যমে ওসিকে দেন। এরপর থানায় কোনো লেনদেন হয়নি মর্মে লিখিত দিয়ে তিনি থানা থেকে ছাড়া পান।

সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে জমিজমা নিয়ে বিরোধ মেটানোর নামে টাকা আদায় ছাড়াও ইটভাটা, নম্বরবিহীন সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও বালুমহাল থেকে নিয়মিত মাসোহারা নেওয়ার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, তিনি নিজেকে ক্ষমতাসীন দলের এক প্রভাবশালী নেতার ভাগনে পরিচয় দিতেন। এ কারণে স্থানীয় ভুক্তভোগীরা তাঁর বিরুদ্ধে মুখ খোলার সাহস পেতেন না।

মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহানের ভিডিও ফুটেজ প্রকাশের ঘটনায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা একটি মামলায় ওসি মোয়াজ্জেমকে গত রোববার রাজধানীর শাহবাগ থানা-পুলিশ গ্রেপ্তার করে। এই মামলায় এখন তিনি কারাগারে। সোনাগাজীতে মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহানের ওপর অগ্নি সন্ত্রাসের ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে ১০ এপ্রিল তাঁকে সোনাগাজী থানা থেকে প্রত্যাহার করা হয়। গ্রেপ্তার হওয়ার পর স্থানীয় ভুক্তভোগী লোকজন তাঁর বিরুদ্ধে এখন মুখ খুলতে শুরু করেছেন।

প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সোনাগাজীর অন্তত ২০–২২ জন ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা সাবেক ওসি মোয়াজ্জেমের হাতে নিগৃহীত হওয়ার বর্ণনা দিয়েছেন।

তবে ওসি মোয়াজ্জেমের আইনজীবী ফারুক হোসেন মঙ্গলবার সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ ধরনের কোনো ঘটনার সঙ্গে তাঁর মক্কেল জড়িত ছিলেন না। এ অভিযোগ পুরোপুরি মিথ্যা। তাঁকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য এ ধরনের অভিযোগ আনা হচ্ছে।’

কিছু ঘটনা

উপজেলার মদিনা বাজার এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ ইসলাম। তিনি জানান, জমির বিরোধ নিয়ে ওসি মোয়াজ্জেম তাঁকে থানায় ডেকে নিয়ে তিন দিন আটকে রাখেন। ৫ লাখ ৪০ হাজার টাকার একটি চেক লিখে নেন। পরে অনেক কষ্ট করে পরিবারের সদস্যরা তাঁকে ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা জোগাড় করে থানা থেকে ছাড়িয়ে নেন।

সোনাগাজী পৌর শহরের অটোরিকশাচালক দেলোয়ার হোসেন জানান, নম্বরবিহীন অটোরিকশা চালাতে হলে ওসি মোয়াজ্জেমকে এককালীন ১০ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। এরপর একটি টোকেন নিয়ে প্রতি মাসে ৫০০ টাকা করে চাঁদা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা ছিল। চাঁদা দিতে দেরি হলে থানায় গাড়ি আটকে রেখে হয়রানি করতেন ওসি।

‘জিম্মি’ ছিল সোনাগাজীবাসী

মোয়াজ্জেম হোসেন ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি ওসি হিসেবে সোনাগাজী মডেল থানায় যোগ দেন। কিছুদিন পর তিনি আবুল খায়ের নামে এক পুলিশ কনস্টেবলকে সোনাগাজী থানায় নিয়ে আসেন। এরপর তাঁকে দিয়ে সোনাগাজী বাজারের বিভিন্ন দোকান, ইটভাটা, যানবাহনসহ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে চাঁদা তোলানো হতো। আবুল খায়েরের বিরুদ্ধে স্থানীয় গণমাধ্যমে চাঁদা তোলার সংবাদ বেরোলে গত বছরের ডিসেম্বরে তাঁকে প্রত্যাহার করে নেয় কর্তৃপক্ষ। এরপর ওসি মোয়াজ্জেম সরাসরি টাকা তুলতেন বলে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ।

সোনাগাজী সার্কেলের সাবেক সহকারী পুলিশ সুপার (বর্তমানে ফেনীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার-সদর) মোহাম্মদ রবিউল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তিনি সোনাগাজীতে দায়িত্বে থাকাকালে ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে কেউ হয়রানি করার অভিযোগ করেননি। কেউ অভিযোগ করলে অবশ্যই তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হতো। তবে একজন ওসির বিরুদ্ধে এ রকম অভিযোগ ওঠা দুঃখজনক।