বড় বাধা নিরাপত্তার অনিশ্চয়তা

মিজানুর রহমান
মিজানুর রহমান

যেসব মানবাধিকার সংস্থা একসময় খুবই সোচ্চার ছিল, তাদের আমরা এখন আর আগের ভূমিকায় দেখতে পাচ্ছি না। কারণটা হচ্ছে, একধরনের ভীতি সঞ্চারিত হয়েছে। এই ভীতি কতটা কাল্পনিক, কতটা বাস্তব, সেই বিতর্ক আমরা করতে পারি। কিন্তু নিরাপত্তাহীনতার বোধ তো ভীষণভাবে আছে। এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।

অনেকেই কথা বলতে চান না। কারণ কোনো কিছুই তো আমাদের এখানে আইননির্ভর নয়। আমাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হবে, আমার পরিবার জানতেও পারবে না আমাকে কোথায় রাখা হয়েছে, আমি বেঁচে আছি কি না।

মানুষের সব অধিকারের মধ্যে প্রধান অধিকার হলো জীবনের অধিকার, নিরাপত্তার অধিকার। সেই জায়গাটি যখন নড়বড়ে হয়ে যায়, তখন কোনো মানুষের পক্ষে তীব্র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে মানবাধিকারের পক্ষে দাঁড়ানো বড় দুরূহ ও কষ্টকর হয়ে পড়ে।

মানবাধিকার সংস্থাগুলো আগের মতো কাজ করতে পারছে বলে মনে হচ্ছে না। রাষ্ট্রে আইনের শাসনের চরম ঘাটতি দেখা দিলে মানুষের মতপ্রকাশের অধিকার ভীষণ সংকুচিত হয়ে যায়। তার একটা প্রভাব বেসরকারি সংস্থার ওপর পড়েছে। গণমাধ্যমেও সেলফ সেন্সরশিপ আছে চরম মাত্রায়।

আরেকটা বিতর্ক চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে—উন্নয়ন চাই, না মানবাধিকার? কিন্তু দুটি তো বিচ্ছিন্ন কোনো বিষয় নয়। অনেকেই বলার চেষ্টা করছে রাষ্ট্রের প্রথম কর্তব্য উন্নয়ন করা। এটা হয়ে গেলে মানবাধিকারের দিকে নজর দেওয়া যাবে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে যখন আমরা তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছি, এই সময়ে মানবাধিকার ক্ষুণ্ন হলেও মেনে নিতে হবে।

আমি বলব, কোনো উন্নয়নই টেকসই উন্নয়ন হয় না, যদি একই সঙ্গে মানব উন্নয়ন না হয়। মানব উন্নয়নের মূল কথাই হলো মানবাধিকার। এটাকে পাকাপোক্ত হতে হয়। এটা না থাকলে শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়। সেটা উন্নয়নের মাপকাঠি নয়। যেখানে মানুষের মর্যাদা আর মানবাধিকারের অবস্থা নাজুক, সেখানে উন্নয়ন বিতর্কিত।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কাজেও যথেষ্ট ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। কমিশন রাষ্ট্রীয় সংস্থা। অনুদানের ওপর নির্ভরশীল নয়। কমিশন হিসেবে আমি আমার দায়িত্বটা পালন করছি কি না, সেটাই বিবেচ্য। কমিশন যদি মনে করে কিছু করলে বা কোনো বিবৃতি দিলে সরকার নাখোশ হবে কি না, তাহলে সেখানেই মানবাধিকার কমিশনের মৃত্যু ঘটে।

কমিশনের কর্তাব্যক্তিরা যদি সাবেক সরকারি কর্মকর্তা হন, তাঁদের পক্ষে সরকারের সমালোচনা করা সম্ভব কি না, সে প্রশ্ন মনে আসে। ইদানীং মানবাধিকার কমিশন মুখ থুবড়ে পড়েছে বললে বেশি বলা হবে না।

আমি টেকনাফে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত একরামুলের কথা বলব। ধর্ষণ, গণধর্ষণ বেড়ে গেছে এ কথা বলব। প্রতিদিনই বন্দুকযুদ্ধ হচ্ছে, কেউ না কেউ প্রাণ হারাচ্ছে। সরকার অসন্তুষ্ট হবে, এ কথা ভেবে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে চুপ করে থাকতে পারে না।

মানবাধিকারের কাজ তো সেখানেই, যেখানে আইনের শাসন লঙ্ঘিত হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। যেখানে সাধারণ নাগরিকেরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। রাষ্ট্র ভুল পথে পরিচালিত হচ্ছে কি না, সেটা ধরিয়ে দেওয়াই কমিশনের কাজ।

 লেখক: সাবেক চেয়ারম্যান, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন

আরও  পড়ুন :-