প্রবীণদের গুরুত্ব দিতে হবে

বক্তব্য দেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। পাশে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি রাশেদ খান মেনন।  ছবি: প্রথম আলো
বক্তব্য দেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। পাশে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। ছবি: প্রথম আলো

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নানা সমস্যায় পড়েন প্রবীণেরা। প্রবীণদের ভাতা দেওয়ার পাশাপাশি কর্মসংস্থান কিংবা আয়ের সুযোগ তাঁদের ক্ষমতায়ন করবে। পরিবারের সদস্যদেরও প্রবীণ অধিকার সুরক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে। কারণ, পরিবার ছাড়া প্রবীণদের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা অসম্ভব। এতেই সমাজে প্রবীণের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হবে।

গতকাল বুধবার সকালে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে ‘প্রবীণ অধিকার সুরক্ষা: চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ’ শীর্ষক এক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা এসব কথা বলেন। হেল্প এইজ ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের সহযোগিতায় এই বৈঠকের আয়োজন করে প্রথম আলো। বৈঠক সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম।

শুরুতে বিষয় উপস্থাপনা করেন হেল্প এইজ ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের এদেশীয় পরিচালক রাবেয়া সুলতানা। তিনি বলেন, দেশের অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন এবং শিশু জন্মের হার কম হওয়ার কারণে বিশ্বব্যাপী প্রবীণ নারী ও পুরুষের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। বর্তমানে দেশের প্রবীণ মানুষের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮ শতাংশ। তিনি বলেন, বাংলাদেশ এ মুহূর্তে প্রবীণবিষয়ক বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। প্রবীণেরা বিপদাপন্ন ও দারিদ্র্যের শিকার, একাকিত্বে জর্জরিত, সরকারি সেবা কার্যক্রমে প্রবীণদের প্রবেশগম্যতা সীমিত এবং সমাজ, রাষ্ট্র, পরিবারের বিভিন্ন পর্যায়ে বৈষম্যের শিকার। প্রবীণদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তাবলয়, প্রবীণ ফাউন্ডেশন গঠনের পরামর্শ দেন তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘের মহাসচিব এ এস এম আতীকুর রহমান বলেন, প্রবীণদের সম্মানের সঙ্গে দেখভাল করতে হবে। প্রবীণেরা পরিবারের বাইরের কেউ নন। প্রবীণ নারীর চেয়ে প্রবীণ পুরুষ সামলানো সহজ। প্রবীণেরা কথা বলতে চান, কিন্তু কেউ শুনতে চায় না। অথচ এই প্রবীণদের হাত ধরেই সবাই বড় হয়েছে। তিনি বলেন, প্রবীণদের জন্য চারটি বিষয় দেখা প্রয়োজন, তা হলো ২৪ ঘণ্টা থাকা–খাওয়ার নিশ্চয়তা, চিকিৎসা, সমবয়সী বন্ধুবান্ধবের সাহচর্য এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতা। প্রবীণদের অবহেলা করা হয়। এ জন্য অনেক প্রবীণ নিবাস প্রয়োজন।

দেশের ছয়টি বিভাগীয় শহরে প্রবীণ নিবাস আছে বলে জানান সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব খাদিজা নাজনীন। তিনি বলেন, সেগুলোর প্রতিটিতে ৫০ জন থাকার ব্যবস্থা আছে। প্রবীণদের জন্য সর্বজনীন পেনশন ভাতার বিষয়ে কিছুটা সীমাবদ্ধতা আছে। তবে ভবিষ্যতে এর সম্প্রসারণের বিষয়টি আসতেই হবে। বর্তমান সরকার প্রবীণদের জন্য উদ্যোগ নিচ্ছে।

ফ্রেড হলোস ফাউন্ডেশনের কান্ট্রি ম্যানেজার জেরিন খাইর বলেন, অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নই প্রবীণদের অবস্থার উন্নতি করতে পারবে। কারণ, হাতে টাকা থাকলেই প্রবীণেরা পরিবারে সিদ্ধান্ত দিতে পারবেন, সেই অবস্থান তৈরি করতে পারবেন।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের সাবেক ঊর্ধ্বতন ফেলো শরীফা বেগম বলেন, যেভাবে সমাজ পরিবর্তন হচ্ছে, তাতে আন্তপ্রজন্ম সম্পর্কগুলোর পরিবর্তনের ফলে প্রবীণেরা খারাপ অবস্থার মধ্যে পড়বেন। প্রবীণদের ওপর নানা রকম নির্যাতন আছে, বৈষম্য আছে। এসব বিষয়ে পরিবারের সদস্যদেরই খেয়াল রাখতে হবে। প্রবীণদের যত্ন না নিলে সমাজটাই দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যাবে।

অ্যাকশন অন ডিজঅ্যাবিলিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ইন্টারন্যাশনালের এদেশীয় পরিচালক শফিকুল ইসলাম বলেন, জনসংখ্যার যে জনমিতিক সুবিধা এখন বাংলাদেশের আছে, তা ৩০ থেকে ৩৫ বছর পরে আর থাকবে না। এই প্রবীণদের কীভাবে কাজে লাগানো যায়, তা এখন থেকেই ভাবতে হবে। ভাতা দেওয়ার পরিবর্তে প্রবীণদের কর্মসংস্থান বা আয়ের সুযোগ করা যায় কি না ভাবতে হবে। প্রবীণদের জন্য একটি ফাউন্ডেশন গঠন করার পরামর্শ দেন তিনি।

হেল্প এইজ ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের ব্যবস্থাপক বেলায়েত হোসেন বলেন, প্রবীণ মানেই দুর্দশাগ্রস্ত নন। প্রবীণদের নিজেদেরও অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। পরিবার ছাড়া প্রবীণদের এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা অসম্ভব। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে সমান্তরালে সচেতন হতে হবে।

বাংলাদেশ উইমেন হেলথ কোয়ালিশনের নির্বাহী পরিচালক শরীফ মোস্তফা বলেন, প্রবীণেরা সম্মান চান। তাঁরা চান, তাঁদের জীবনের দীর্ঘ পথের অভিজ্ঞতাকে মানুষ প্রশংসা করুক। বার্ধক্য তো কোনো অপরাধ নয়। পরিবার ছোট হয়ে আসায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্তের সম্মুখীন প্রবীণ ও শিশুরা। অভিভাবকেরা শিশুদের যত্ন নিয়ে থাকেন, কিন্তু প্রবীণদের অত যত্ন নেওয়া হয় না।

রিসোর্স ইন্টিগ্রেশন সেন্টারের (রিক) সাধারণ পরিষদের সদস্য তোফাজ্জল হোসেন বলেন, রাষ্ট্র যতক্ষণ না পর্যন্ত প্রবীণ সংগঠন এবং সহায়তার জায়গায় ভূমিকা পালন করবে, ততক্ষণ রাষ্ট্রের উদ্যোগগুলো সীমিত আকারেই থাকবে। মাঠপর্যায়ে প্রবীণ সংগঠনকে শক্তিশালী করতে হবে। প্রবীণেরাও যে জনসংখ্যাভিত্তিক লভ্যাংশের অংশ, সেটি মনে করে উদ্যোগ নিতে হবে।

হেল্প এইজ ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের প্রকল্প ব্যবস্থাপক এনামুল হক বলেন, প্রবীণদের সম্পদ হিসেবে চিন্তা করতে হবে। প্রবীণদের শারীরিক সক্ষমতা হয়তো সীমিত থাকে, কিন্তু তাঁদের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান থাকে অনেক। স্থানীয় আপদ, পরিবেশের পরিবর্তন সম্পর্কে প্রবীণদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে দুর্যোগ মোকাবিলার কাজ এগিয়ে নেওয়া সম্ভব।