তহবিল কমছে, কাজ সংকুচিত হচ্ছে

পুলিশের হেফাজতে পল্লবীর ইশতিয়াক হোসেন খুন হওয়ার পর মামলা করেছিলেন তাঁর ভাই মো. রকি। তাঁকে আইনি সহযোগিতা দিচ্ছিল যে প্রতিষ্ঠানটি, গত বছরের মাঝামাঝি থেকে সেটার একটু গা ছাড়া ভাব দেখা যায়। রকি এখন চিন্তায় পড়েছেন।

রকি প্রথম আলোকে বলেন, ইশতিয়াক নিহত হয়েছিলেন ২০১৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। পুলিশ মামলা নেয়নি। তখন বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির (বিএনডব্লিউএলএ) সহায়তায় তিনি সরাসরি ঢাকার জজ আদালতে মামলা করেন। পরের বছর নিম্ন আদালতে মামলার বিচার শুরু হয়।

কিন্তু গত বছর আসামিপক্ষ মামলা বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে রিট করে। হাইকোর্ট নিম্ন আদালতে মামলার কার্যক্রমের ওপর স্থগিতাদেশ দেন। একটি মোটর গ্যারেজের শ্রমিক রকি বিএনডব্লিউএলএতে যোগাযোগ করে জানতে পারেন, তাঁর আইনজীবী আর সেখানে নেই। এমনকি জজ আদালতে সংগঠনের শাখা অফিসটাও নেই। সংগঠনটি চলছে নির্বাহী পরিচালক ছাড়া।

রকি শেষ পর্যন্ত হাইকোর্টে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) সহযোগিতা পেয়েছেন। হাইকোর্টের রায়ে বিচারের স্থগিতাদেশ উঠেছে। কিন্তু তাঁর চিন্তা, নিম্ন আদালতে এখন কে তাঁকে মামলায় সাহায্য করবে। অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের হুমকি-ধমকি, টাকার লোভ—সব উপেক্ষা করে ন্যায়বিচারের আশায় লেগে ছিলেন রকি।

বিএনডব্লিউএলএর সাবেক ও বর্তমান কয়েকজন কর্মী বলেছেন, তহবিল নেই। কর্মী আর সেবা কাটছাঁট হয়েছে। এর ফলে ভুগছেন বিচারপ্রার্থীরা। ১৯৭৯ সালে গঠিত নারী আইনজীবীদের এই মোর্চা সংগঠনটি অপ্রাপ্তবয়স্ক যৌনকর্মী আর পাচার হওয়া নারী-শিশুদের উদ্ধার, প্রত্যাবাসনসহ নির্যাতনের বিরুদ্ধে বহু মামলা করেছে।

প্রতিষ্ঠানের পরিচালক তৌহিদা খন্দকার প্রথম আলোকে বলেন, দাতা সংস্থাগুলো এখন আর দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পে সহায়তা দিচ্ছে না। একটা সময় দেশব্যাপী সংগঠনের গড়ে পাঁচ বছরমেয়াদি ২০-২২টি প্রকল্প চলত। ৩০-৩৫টি জেলায় অফিস ছিল, আইনজীবীরা ছিলেন। এখন প্রকল্প মাত্র ৯টি, সবই স্বল্পমেয়াদি।

দেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সেবাদান পরিস্থিতি নিয়ে প্রথম আলোর অনুসন্ধান বলছে, কমপক্ষে আরও তিনটি মানবাধিকার সংগঠন তহবিলসংকটে ভুগছে। প্রতিষ্ঠানগুলো বিদেশি সাহায্য ও প্রকল্পনির্ভর হওয়ায় কিছু কাজ থমকে পড়ছে। এ ছাড়া প্রায় সব কটি প্রথম সারির প্রতিষ্ঠানে অভ্যন্তরীণ সাংগঠনিক সমস্যাও আছে।

টাকা বন্ধ, প্রকল্প শেষ

মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, দাতারা এখন পছন্দসই অল্প কিছু প্রকল্প ছাড়া টাকা দিতে চাইছে না। এমন সংগঠনের নিবন্ধক প্রতিষ্ঠান এনজিও অ্যাফেয়ার্স ব্যুরোর উপসচিব হুর–এ–জান্নাত প্রথম আলোকে বলেছেন, এখন সহায়তা আসছে প্রধানত প্রচার-প্রচারণা ও প্রশিক্ষণের কাজে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রকে (আসক) সহায়তা দিত নরওয়ে, ডেনমার্ক ও সুইজারল্যান্ডের দূতাবাস, সুইডেন ও জার্মানির বৈদেশিক সাহায্য সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা অক্সফাম। ২০১৭ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১২-১৬ সাল পর্যন্ত আসকের মোট বাজেট ছিল ৮০ কোটি টাকার কাছাকাছি।

নরওয়ের দূতাবাস পররাষ্ট্রনীতিতে বদলের কথা বলে ২০১৫ সালে তহবিল বন্ধ করে দেয়। আসককে পরিকল্পনার ৬০ শতাংশে পরিবর্তন আনতে হয়। প্রতিবেদনটিতে আসক লিখেছে, এতে দরিদ্র, ঝুঁকিতে থাকা শক্তিহীন মানুষের সেবা পাওয়া কমে যায়। খরচ সামাল দিতে গিয়ে আসক দক্ষ ও নিবেদিতপ্রাণ অনেক কর্মীকে ছাঁটাই করে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আসকের তদন্ত দলের একজন কর্মকর্তা বলেন, মোট তহবিলের প্রায় অর্ধেক দিত নরওয়ে। তহবিল প্রত্যাহারের পর ১৬০ জনের বদলে কর্মীসংখ্যা দাঁড়াল ৫৬। নয়জনের তদন্ত দল চারজনে নেমে এল। জনস্বার্থে রিটকারী বেশির ভাগ আইনজীবীও পড়ে যান ছাঁটাইয়ের তালিকায়। আগে বছরে শতাধিক তথ্যানুসন্ধান ও প্রতিবেদন তৈরি হতো, এখন তা অর্ধেকে নেমে এসেছে।

এনজিও ব্যুরোর হুর–এ–জান্নাত প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৪ থেকে নিয়ে পাঁচ বছরে আসকের আটটি প্রকল্প চলছে। পাঁচটিই শিশু অধিকার নিয়ে। বাকি তিনটি মানব পাচার রোধ, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়ন এবং গণতন্ত্রকে সুসংহত করা বিষয়ক।

অথচ ১৯৮৬ সালে প্রতিষ্ঠিত আসক অতীতে কারাবন্দীদের সমস্যা, বস্তি উচ্ছেদ, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, জঙ্গি তৎপরতা পর্যবেক্ষণ নিয়ে কাজ করত। সংগঠনটির বড় কাজ ছিল নির্যাতন নিয়ে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্যাতন এবং নারী-শিশু গৃহকর্মী, অভিবাসী শ্রমিক, সাংবাদিক, সংখ্যালঘু বা ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষদের ওপর ঘটে চলা নির্যাতন। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা অবশ্য বলছেন, এখনো তাঁরা মানবাধিকার লঙ্ঘনের সবদিকেই নজর রাখতে চেষ্টা করছেন।

২০১৫ সালে নরওয়ের দূতাবাস বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তহবিলও বন্ধ করে দেয়। এই নারী অধিকার সংগঠনে এখন মানবাধিকারবিষয়ক একটিমাত্র প্রকল্প চলছে, সুইডিশ সরকারের অর্থায়নে। ১৯৯৪ সালে প্রতিষ্ঠিত অধিকারের নিবন্ধনের নবায়ন আটকে আছে পাঁচ বছর। কাজকর্ম এখন প্রায় শূন্যের কোঠায়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কমপক্ষে ছয়জন পুরোনো মানবাধিকারকর্মী প্রথম আলোকে বলেন, সংগঠনগুলোর অতিরিক্ত প্রকল্পনির্ভরতাই কাল হয়েছে। কয়েক বছর হলো বিদেশি দাতারা ক্রমেই সরে পড়ছে। মানবাধিকার বিষয়ে রাষ্ট্রের কোনো পরিকল্পনার কথাও শোনা যাচ্ছে না।

সাংগঠনিক সংকট

ব্র্যাক, মাদারীপুর লিগ্যাল এইড অ্যাসোসিয়েশন, আসক, ব্লাস্ট, বিএনডব্লিউএলএর কয়েকজন কর্মী বলেছেন, সংগঠনগুলোয় এখন আন্দোলনের (অ্যাকটিভিজম) মানসিকতার সংকট দেখা দিয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনডব্লিউএলএর সাবেক এক কর্মী প্রথম আলোকে বলছিলেন, সেনানিবাসের ভেতর সোহাগী জাহান তনু খুন হওয়ার পর সমিতির সে সময়কার নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী কুমিল্লা চলে গিয়ে সব বাধা ঠেলে তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন। এখন তেমনটা কেউ করেনি।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৭০ সালে। এটি দেশের বৃহত্তম নারী সংগঠন। সংগঠনটির বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী এর সদস্য এখন পৌনে দুই লাখের মতো। গত শতকের নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে সংগঠনটি বিদেশি তহবিলনির্ভর হয়ে পড়ে। কিন্তু শুরু থেকে দুই দশকের বেশি সময় সংগঠনটি সদস্যদের আর দেশীয় শুভানুধ্যায়ীদের সহযোগিতায় চলেছে। রাজনৈতিক, সামাজিক ও নারী অধিকারের আন্দোলন গড়ে তুলেছে। এসব আন্দোলনে দেশের প্রগতিশীল বামপন্থী ব্যক্তিরা পাশে থেকেছেন।

নারী নির্যাতনের বিভিন্ন ঘটনায় ও যৌতুকবিরোধী আন্দোলন আর সম্পত্তিতে নারী-পুরুষের সমানাধিকারসহ সর্বজনীন পারিবারিক আইনের দাবিতে সত্তরের দশক থেকে মহিলা পরিষদ জোরদার আন্দোলন গড়েছিল। ১৯৯৩ সালে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে নূরজাহানকে পাথর ছুড়ে হত্যার পর ফতোয়াবিরোধী আন্দোলনে সংগঠনটির জোরালো ভূমিকা ছিল।

কিন্তু একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রাতে নোয়াখালীর সুবর্ণচরে গণধর্ষণের শিকার নারীর পাশে সংগঠনটি যায়নি। যায়নি বেশির ভাগ বড় সংগঠনই। ওই নারীর অভিযোগ ছিল, নৌকায় ভোট না দেওয়ার কারণে তাঁকে নির্যাতিত হতে হয়েছে।

মহিলা পরিষদের গত বছরের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী বিভাগীয় সংগঠকেরা তাঁদের কাজের বিবরণ কেন্দ্রে পাঠাননি। আইনি সেবা পেয়েছেন মাত্র ১৫৩ জন ভুক্তভোগী। মাঠপর্যায়ে মাত্র দুটি বাল্যবিবাহ ঠেকিয়েছেন তাঁরা। একজন কর্মী বলেছেন, পরিষদের কাজ এখন ঢাকার অফিসকেন্দ্রিক। পারিবারিক আইনের সংস্কার নিয়েও আন্দোলন চোখে পড়ে না।

সংগঠনটির আইনি সহায়তা বিভাগের পরিচালক মাকসুদা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, সম্প্রতি ফেনীর সোনাগাজীতে নুসরাত জাহানকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটি অনেক দিন পর ঢাকায় মিছিল করেছে। তবে সব কটি জেলা কমিটি কর্মসূচি দেয়নি। একাধিক কর্মী বলেছেন, সব জেলা কমিটি সক্রিয় নয়। তাঁদের মতে, কেন্দ্রীয় কমিটির তত্ত্বাবধানেও ঘাটতি আছে।

২০১৬ সালে সুলতানা কামাল আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালকের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। ভারপ্রাপ্ত পরিচালক হন তদন্ত ইউনিটের প্রধান নূর খান। কিছুদিন পর তিনিও চলে যান। সংস্থাটির সঙ্গে বিভিন্ন সময় যুক্ত ব্যক্তিরা নেতৃত্বের সংকট অনুভব করছেন। তবে আসকের বর্তমান নির্বাহী পরিচালক শিপা হাফিজা তেমনটা মনে করেন না। তিনি বলেছেন, তাঁরা বেশিসংখ্যক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় ভূমিকা রাখছেন, নতুন করে বিদেশি সাহায্যও পাচ্ছেন। যদিও এর সমর্থনে তিনি তথ্য-উপাত্ত দেননি।

বিএনডব্লিউএলএর সাংগঠনিক সমস্যার আবার একটা ভিন্ন মাত্রা আছে। সংগঠনটির বহুদিনের নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী ২০১৭ সালে পদত্যাগ করার পর থেকে পদটি শূন্য। রানা প্লাজা প্রকল্পের আর্থিক অনিয়ম নিয়ে প্রতিষ্ঠানের ভেতরে অভিযোগ উঠেছিল। এই প্রসঙ্গে মতভেদের জেরে সালমা আলীর বিদায় ঘটে। এখন নির্বাহী কমিটির ১৭ সদস্যের সবাই ওকালতি করেন। সংগঠনে তাঁরা স্বেচ্ছাসেবী। তাঁরা সার্বক্ষণিক ভূমিকা রাখতে পারছেন না।

মানবাধিকারকর্মী ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল প্রথম আলোকে বলেছেন, মানবাধিকারের কাজ করতে গেলে রাষ্ট্রসহ প্রবল প্রতিপক্ষের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়। সাহসী ও শক্তিশালী নেতৃত্ব থাকাটা তাই খুবই জরুরি। সেটাই কষ্টকর হয়ে উঠছে।

ব্লাস্টের সাম্মানিক নির্বাহী পরিচালক সারা হোসেন ও বিএনডব্লিউএলএর সভাপতি ফওজিয়া করিম ফিরোজ নেতৃত্বের পাশাপাশি অর্থসংস্থানের বিষয়টিকেও গুরুত্ব দিচ্ছেন। সারা হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, যুক্তরাজ্যের মতো উন্নত দেশগুলোয় মানবাধিকার বিষয়ে সরকার ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দুই-ই কাজ করে। ফওজিয়াও বলছিলেন, পশ্চিমা দেশে সরকার কিংবা ধনীদের ফাউন্ডেশন মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তহবিল জোগায়। বাংলাদেশেও এমনটা প্রয়োজন। (শেষ)

সংশোধনী: গতকাল অধিকারের সাধারণ সম্পাদক আদিলুর রহমান খানকে ভুলবশত নির্বাহী পরিচালক লেখা হয়েছিল। এ জন্য আমরা দুঃখিত।