নারী কর্মকর্তাকে শাসালেন আ. লীগ নেতা

‘তুই আমাকে চিনিস? আমার নাম শুনেছিস? তোকে আমি দেখে নেব। আমি না চাইলে তুই ইজ্জত নিয়ে বের হতে পারবি?’ এভাবে চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার এক নারী কর্মকর্তাকে মুঠোফোনে শাসিয়েছেন চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোছলেম উদ্দিন আহমদ।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উপজেলার ১০টি ইউনিয়নে ১২টি সেতু নির্মাণের জন্য দরপত্রের ফরম বিক্রি উন্মুক্তভাবে না করতে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা সুপ্তশ্রী সাহাকে অনুরোধ করেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা। কিন্তু এই কর্মকর্তা তাঁদের অনুরোধ শোনেননি। এরপর গত বুধবার প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাকে ফোন করে সন্ধ্যা সাতটার পর উপজেলা ডাকবাংলোয় সাক্ষাৎ করতে বলেন মোছলেম উদ্দিন। তাঁর নির্দেশ মানতে অস্বীকৃতি জানালে সুপ্তশ্রীকে গালমন্দ করা হয়।

তবে পুরো ঘটনা অস্বীকার করেন মোছলেম উদ্দিন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘অভিযোগটি সত্য নয়। আমি এ বিষয়ে কিছুই জানি না।’

এদিকে সুপ্তশ্রী সাহা বিষয়টি তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানিয়েছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার ১২টি সেতু নির্মাণের উন্মুক্ত দরপত্রে ২৮২টি ফরম বিক্রি হয়। ২৩ জুন ঠিকাদারদের উপস্থিতিতে দরপত্রের বাক্স খোলার দিন ধার্য রয়েছে। কাজটি ২ কোটি ৮০ লাখ ৩৪ হাজার ৪৪৫ টাকার।

স্থানীয় প্রশাসন সূত্র জানায়, উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান না করতে বোয়ালখালী উপজেলা চেয়ারম্যান ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা নুরুল আলমও বুধবার দুপুরে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাকে সরাসরি অনুরোধ করেন। কিন্তু নিয়মের বাইরে কিছু করতে রাজি হননি সুপ্তশ্রী। এরপর উপজেলা চেয়ারম্যানের এক আত্মীয় আবারও এ অনুরোধ জানান। সুপ্তশ্রী তাঁকেও জানান, তিনি এ অনুরোধ রাখতে পারবেন না।

উপজেলা চেয়ারম্যানও অভিযোগ অস্বীকার করেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, বুধবার তিনি তথ্য কমিশনের কর্মকর্তার সঙ্গে সরকারি কাজে ব্যস্ত ছিলেন। সুপ্তশ্রী সাহার সঙ্গে দরপত্র নিয়ে কথা হয়নি।

নারী কর্মকর্তার সঙ্গে মোছলেম উদ্দিনের কথোপকথনের বিষয়ে জানা যায়, বুধবার সন্ধ্যা পৌনে ছয়টায় আওয়ামী লীগ নেতা মোছলেম উদ্দিন আহমদ সুপ্তশ্রীকে ফোন দিয়ে প্রথমে কুশল বিনিময় করেন। একপর্যায়ে মোছলেম উদ্দিন সুপ্তশ্রীকে বলেন, ‘আপনি আমাকে চেনেন?’ জবাবে সুপ্তশ্রী বলেন, ‘চিনি না। তবে আপনার নাম শুনেছি।’ এ পর্যায়ে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন মোছলেম উদ্দিন। তিনি ১২ সেতুর উন্মুক্ত দরপত্র বন্ধ রাখতে বলেন। সুপ্তশ্রী রাজি না হলে তাঁর সঙ্গে খারাপ আচরণ করেন।

>

‘তুই আমাকে চিনিস?’
‘আমি না চাইলে তুই ইজ্জত নিয়ে বের হতে পারবি?’

গতকাল বোয়ালখালী উপজেলা পরিষদ ভবনে সুপ্তশ্রী সাহার সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘২ কোটি ৮০ লাখ টাকার উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান বন্ধ রাখতে উপজেলা চেয়ারম্যান মহোদয় আমাকে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু সরকারি কাজের দরপত্র বন্ধ রাখার এখতিয়ার আমার নেই। বিষয়টি তাঁকে বিনয়ের সঙ্গে জানিয়ে দিই। এরপর বুধবার ৫টা ৪৬ মিনিটে মোছলেম উদ্দিন আহমদ আমাকে ফোন করে একই অনুরোধ করেন। তিনি আমাকে সন্ধ্যা সাতটার পর ডাক বাংলোয় দেখা করতে বলেন। আমি লেডি অফিসার (নারী কর্মকর্তা)। সাতটার পর আমি কেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাব? এসব কারণে তিনি আমার ইজ্জত নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। বিষয়টি আমার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানিয়েছি।’

বোয়ালখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) একরামুল ছিদ্দিক ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আমাকে বুধবার সন্ধ্যায় বিষয়টি মোবাইল ফোনে জানিয়েছেন। তাঁকে নাকি সন্ধ্যার পর ডাক বাংলোয় যেতে বলা হয়েছিল। গালাগালও নাকি করা হয়েছে। তাঁকে আমি লিখিত অভিযোগ দিতে বলেছি।’ ইউএনও আরও বলেন, এই নারী কর্মকর্তার কোনো সমস্যা যেন না হয় সে ব্যাপারে নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণাধীন গ্রামীণ রাস্তায় সেতু ও কালভার্ট নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় ২০১৮-১৯ অর্থবছরে উপজেলার ১০ ইউনিয়নে ১২টি সেতু নির্মাণের প্রকল্প অনুমোদন হয়। স্থানীয় আওয়ামী লীগ দরপত্র আহ্বানের পরিবর্তে কাজ নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা অনড় অবস্থানে থাকায় তা ভেস্তে যায়।