দুর্নীতির প্রমাণ মিললেও পদোন্নতির তোড়জোড়

যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর। ফাইল ছবি
যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর। ফাইল ছবি
>

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রতিবেদনে দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। কিন্তু কারও বিরুদ্ধে আজ পর্যন্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

ঘুষের দুই খাত থেকে মাসে প্রায় আড়াই লাখ টাকা কামাচ্ছিলেন যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দরের সাবেক ভারপ্রাপ্ত পরিচালক (ট্রাফিক) আমিনুল ইসলাম। এই তথ্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বিশেষ প্রতিবেদনের। পরে বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের তদন্তে অভিযোগের সত্যতা মেলে। আমিনুলসহ সংশ্লিষ্ট কয়েকজনকে বদলিও করা হয়েছে। কিন্তু সেই আমিনুলকেই এখন প্রতিষ্ঠানের সচিব করার তোড়জোড় চলছে।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বিশেষ প্রতিবেদনটি আট পৃষ্ঠার। তাতে সই রয়েছে মোহাম্মদ মমিনুর রহমানের। তিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক-১২। প্রতিবেদনটিতে বেনাপোল স্থলবন্দরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতি নিয়ে একটি অংশ রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, আমদানি করা পণ্য নিয়ে প্রতিদিন ভারতীয় ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান বেনাপোল স্থলবন্দরে আসে। পণ্য নামানোর পর যেসব গাড়ি, দিনে দিনেই ফিরে যায় তাদের কোনো মাশুল দিতে হয় না। কিন্তু পণ্য না নামানোর কারণে অনেক গাড়ি বন্দরে কমবেশি ১০ দিন অবস্থান করে। একদিন অবস্থান করলে ৬৫ টাকা ১১ পয়সা মাশুল দিতে হয়। এর বেশি হলে প্রতিদিনের জন্য মাশুল দিতে হয় ৮৬ টাকা ৭৭ পয়সা করে। বন্দরের ১১ নম্বর ফটকের ভেতরে ও ট্রান্সশিপমেন্ট ইয়ার্ডে মাশুল পরিশোধ করা যায়। সেখান থেকে সংগ্রহ করা রসিদ কার্গো শাখার (আমদানি) কর্মকর্তাদের দেখাতে হয়। একই রসিদ পরে তল্লাশিচৌকিতে দেখানোর পরই সংশ্লিষ্ট গাড়িটির ভারতে ফেরার অনুমতি মেলে।

প্রতিবেদন মোতাবেক, কার্গো শাখার (আমদানি) টংঘরে দায়িত্ব পালন করেন ওয়্যারহাউস সুপারিনটেনডেন্ট আমিনুল ইসলাম, এস এম মাসুম বিল্লাহ ও ফিদা হাসান। তাঁদের মধ্যে মাসুম বিল্লাহ বন্দরে ৫-১০ দিন অবস্থান করা ২০-২৫টি ভারতীয় গাড়ি থেকে প্রতিদিন মাশুল আদায় করেন। এসব গাড়ি থেকে তিনি দিনে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা আদায় করেন। এরপর তিনি পুরোনো এবং অন্যের ব্যবহৃত মাশুল রসিদ দিয়ে সেসব গাড়ি ভারতে যেতে সহায়তা করেছেন। ফলে ওই টাকা বন্দর কর্তৃপক্ষ পায়নি। অবৈধ এই টাকা থেকে বন্দরের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত পরিচালক (ট্রাফিক) আমিনুল ইসলাম সপ্তাহে ২০ হাজার এবং হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আবদুল হান্নানকে ৫ হাজার টাকা ভাগ পেয়েছেন।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বন্দরে আমদানি করা মালামালে প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৩৫০টি কনসাইনমেন্ট (পণ্য চালান) থাকে। প্রতিটি কনসাইনমেন্টে স্বাক্ষর বাবদ আমদানিকারকের লোকজনের কাছ থেকে বন্দরের রাজস্ব দপ্তরের লোকজন ১০০ টাকা করে ঘুষ নেন। এখান থেকে প্রতিদিন ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা ওঠে। এই টাকা থেকে আমিনুল সপ্তাহে ৪০ হাজার টাকা এবং আবদুল হান্নান ১০ হাজার টাকা ভাগ পেয়েছেন।

তবে আমিনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, এসব ডাহা মিথ্যা কথা। কনসাইনমেন্টপ্রতি ১০০ টাকা করে নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। অবস্থান মাশুল বাবদ টাকা তুলে ভাগ নেওয়ার অভিযোগও একটা ষড়যন্ত্র। এসবে তিনি জড়িত নন এবং তিনি একটি টাকাও নেননি।

প্রতিবেদন মোতাবেক উৎকোচ গ্রহণকারী অন্যরা হলেন ট্রাফিক পরিদর্শক আবু দাউদ খান, জাকির হোসেন, এ কে এম সাইফ উদ্দিন এবং ওয়্যারহাউস সুপারিনটেনডেন্ট মো. রাসেল শেখ, খন্দকার সপিকুল ইসলাম, মো. জিল্লুর রহমান, তন্ময় চাকমা, ফাতেমা আক্তার, উম্মে সালমা। গত বছরের ১৫ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে প্রতিবেদনটি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর পাঠানো হয়।

প্রতিবেদনে দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। কিন্তু কারও বিরুদ্ধে আজ পর্যন্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। কয়েকজনকে বদলি করা হয়েছে মাত্র। আমিনুল ইসলাম বদলি হয়ে বর্তমানে আখাউড়া স্থলবন্দরের উপপরিচালক (ট্রাফিক)। শাস্তির বদলে উল্টো তাঁকে পদোন্নতি দিয়ে বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব করার তোড়জোড় চলছে। গত ১৮ এপ্রিল স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের ৬৪তম সাধারণ বোর্ড সভা হয়। তাতে ‘সন্তোষজনক এসিআর (বার্ষিক গোপন প্রতিবেদন) এবং চাকুরী বিবেচনায়’ আমিনুলের পদোন্নতির সুপারিশ করা হয়েছে।

বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান তপন কুমার চক্রবর্তী গত বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘পদোন্নতি একটি নিয়মিত প্রক্রিয়া। কাগজপত্র ঠিক থাকলে তিনি পদোন্নতি পাবেন, এটাই স্বাভাবিক।’

এদিকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বিশেষ প্রতিবেদনটি পাওয়ার পর নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সাতটি সুপারিশ করে একটি চিঠি গত ২ ডিসেম্বর চেয়ারম্যান তপন কুমার চক্রবর্তীর কাছে পাঠায়। তিনি বিষয়টি তদন্ত করতে ৬ ডিসেম্বর বেনাপোল স্থলবন্দরের পরিচালক (ট্রাফিক) বরাবর চিঠি দেন। বন্দরের পরিচালক (ট্রাফিক) প্রদোষ কান্তি দাস গত ১২ মার্চ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারপ্রাপ্ত পরিচালক (ট্রাফিক) আমিনুল ইসলাম এবং হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আবদুল হান্নান বেনাপোল স্থলবন্দরের সব অপকর্মের সঙ্গে জড়িত। তা ছাড়া ওয়্যারহাউস সুপারিনটেনডেন্ট আমিনুল ইসলাম, ফিদা হাসান ও মাসুম বিল্লাহর নামে দুর্নীতির অভিযোগ দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। রাজস্ব শাখার ট্রাফিক পরিদর্শক আমিনুল হক, আবু দাউদ খান, জাকির হোসেন, এ কে এম সাইফ উদ্দিন এবং ওয়্যারহাউস সুপারিনটেনডেন্ট মো. রাসেল শেখ, খন্দকার সপিকুল ইসলাম, মো. জিল্লুর রহমান, তন্ময় চাকমা, ফাতেমা আক্তার ও উম্মে সালমার বিরুদ্ধে কনসাইনমেন্টপ্রতি ১০০ টাকা ঘুষ গ্রহণের অভিযোগও সত্য।

প্রমাণ পাওয়ার পরও আইনগত ব্যবস্থা না নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে চেয়ারম্যান তপন কুমার চক্রবর্তী বলেন, দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়ায় বেশির ভাগ কর্মকর্তাকে বদলি করে দেওয়া হয়েছে। আর বিষয়টি তদন্ত পর্যায়ে থাকায় আইনানুগ অন্য কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

তবে প্রথম আলোর অনুসন্ধান বলছে, ‘বেশির ভাগ’ কর্মকর্তাকে বদলির দাবিও সত্য নয়। প্রদোষ কান্তি দাসের প্রতিবেদনে মোট ১৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ পাওয়ার কথা আছে। কিন্তু তাঁদের মধ্যে মাত্র চারজন বদলি হয়েছেন। আমিনুল ইসলাম ছাড়া ওয়্যারহাউস সুপারিনটেনডেন্ট মাসুম বিল্লাহ বুড়িমারী স্থলবন্দরে এবং খন্দকার সপিকুল ইসলাম ভোমরা স্থলবন্দরে বদলি হয়েছেন। আর ট্রাফিক পরিদর্শক আমিনুল হককে পাঠানো হয়েছে বুড়িমারী স্থলবন্দরে। হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আবদুল হান্নান, ওয়্যারহাউস সুপারিনটেনডেন্ট ফিদা হাসান, আমিনুল ইসলাম, রাসেল শেখ, জিল্লুর রহমান, তন্ময় চাকমা, ফাতেমা আক্তার ও উম্মে ছালমা এবং ট্রাফিক পরিদর্শক আবু দাউদ খান, জাকির হোসেন ও সাইফ উদ্দীন বেনাপোল স্থলবন্দরেই রয়েছেন।