'আমি শ্যাষ হইয়া গেলাম'

লাদেম মাতবর ও আবু বকর সিদ্দিক। ছবি: সংগৃহীত
লাদেম মাতবর ও আবু বকর সিদ্দিক। ছবি: সংগৃহীত

মাদারীপুর সদরের লুৎফর মাতবরের ছেলে লাদেম মাতবরের বয়স ২০ বছর। পড়ালেখায় মনোযোগী না হওয়ায় তিনি ছেলেকে বিদেশে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন। এলাকার লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারেন, ইতালিতে যাওয়া সহজ। আয়ের সুযোগ বেশি।


আট লাখ টাকায় ছেলেকে ইতালিতে পৌঁছে দেবে, দালালের এই শর্তে রাজি হন লুৎফর মাতবর। সাড়ে তিন লাখ টাকা ধার করেন, আড়াই লাখ টাকায় নিজের কৃষিজমি বিক্রি করে টাকা জোগাড় করেন।

গত ৩১ মে তিউনিসিয়া উপকূলে ভূমধ্যসাগরে ৬৪ বাংলাদেশিসহ ৭৫ অভিবাসনপ্রত্যাশীকে উদ্ধার করে একটি নৌকা। তাঁরা লিবিয়া হয়ে ইউরোপে ঢোকার চেষ্টা করছিলেন। ওই ৬৪ জনের একজন লুৎফর মাতবরের ছেলে লাদেম। প্রায় তিন সপ্তাহ সাগরে ভাসার পর শুক্রবার বিকেলে লাদেমসহ ১৭ জন দেশে ফিরেছেন।

লুৎফর মাতবর মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছেলে কবে ফিরবে, জানতাম না। তাই বিমানবন্দরে যেতে পারিনি। আট লাখ টাকা খরচ করে ছেলেকে বিদেশ পাঠাইছি। ধারের একটা টাকাও শোধ করি নাই। নিজের জমি বেচে দিছি। আমি শ্যাষ হইয়া গেলাম।’

অভিবাসনপ্রত্যাশীদের উদ্ধার করা নৌকাটিকে তীরে ভেড়ার অনুমতি দিচ্ছিল না তিউনিসিয়ার কর্তৃপক্ষ। অভিবাসনপ্রত্যাশীদের নৌকাটি উপকূলীয় জারজিস শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে সাগরে ভাসতে থাকে। তিন সপ্তাহ তিউনিসিয়ার সাগরে ভেসে থাকতে হয় তাঁদের।

তিউনিসিয়ায় বাংলাদেশের দূতাবাস নেই। পাশের দেশ লিবিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তারা এই বিষয়ে তিউনিসিয়া কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। আটকে পড়া বাংলাদেশিরা দেশে ফিরে যাবেন, দূতাবাসের পক্ষ থেকে তিউনিসিয়ার কর্তৃপক্ষকে এমন নিশ্চয়তা দেওয়ার পর ১৮ জুন সন্ধ্যায় তাঁদের জারজিস বন্দরে নামার অনুমতি দেওয়া হয়।

রেড ক্রিসেন্ট জানায়, বন্দরে নামার অনুমতি দিলেও স্থানীয় কর্তৃপক্ষ কোনোক্রমেই তাঁদের জারজিস বা মেডেনিনে থাকার অনুমতি দেয়নি। ফলে উদ্ধার করা বাংলাদেশিদের কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থায় তিউনিসে এনে রেড ক্রিসেন্ট ও আন্তর্জাতিক শরণার্থী সংস্থার (আইওএম) যৌথভাবে পরিচালিত আশ্রয়কেন্দ্রে রাখা হয়। সেখান থেকে পর্যায়ক্রমে তাঁদের দেশে পাঠানো হচ্ছে।

শুক্রবার বিকেলে কাতার এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইটে ১৭ জন তিউনিসিয়া থেকে ঢাকায় পৌঁছান। রাত ৯টায় এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত অভিবাসন পুলিশের হেফাজতে রেখে তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছিল। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই ১৭ জনের মধ্যে ৮ জন মাদারীপুরের, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ৪ জন। এ ছাড়া একজন করে রয়েছেন নোয়াখালী, চাঁদপুর, শরীয়তপুর, মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জের।

তিউনিসিয়া থেকে দেশে ফেরত আসা লোকজনের মধ্যে রয়েছেন আবু বকর সিদ্দিক নামে একজন। তাঁর বাবা আবদুল জব্বার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এলাকার এক লোক লিবিয়া থাকে। সে বলছে, সাড়ে চার লাখ টাকায় ছেলেকে ইউরোপে নিয়ে যাবে। নিজের জমানো সব টাকা আর ধার করে টাকা জোগাইছি। ছেলে ধরা পড়ছে শোনার পর থেকে নাওয়া-খাওয়া বন্ধ। এখন কী করব জানি না।’

লিবিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাস বলছে, প্রথম দফায় ২০ জনকে টিকিট দিলেও তিনজন আসতে রাজি হননি। বাকি ১৭ জন শুক্রবার বিকেলে ঢাকায় আসেন। তিনজন দেশে আসতে রাজি না হওয়ার বিষয়টি নতুন দুশ্চিন্তার কারণ। কেননা ৬৪ জনের দেশে ফিরে যাওয়ার বিষয়ে তিউনিসিয়া কর্তৃপক্ষকে নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে।

দূতাবাসের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাঁদের জন্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসা, কাপড় এবং তিউনিসে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেছে। এ ছাড়া তাঁদের স্বজনের সঙ্গে দেশে কথা বলার ব্যবস্থা করা হয়েছে। উদ্ধার করা সবাই দেশে ফিরে না গেলে পরবর্তীতে এমন দুর্ঘটনায় তিউনিসিয়া কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে বলে দূতাবাসের কর্মকর্তারা মনে করেন।

ভূমধ্যসাগর দিয়ে এভাবে বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে সংকটে ফেলছে বলে মনে করেন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান। তিনি বলেন, এই ধরনের মানব পাচার যেকোনো মূল্যে বন্ধ করতে হবে।