জসিম উদ্দিনের কৃষিঋণ অ্যাপ

কৃষিঋণ সহজীকরণ অ্যাপ তৈরি করেন মো. জসিম উদ্দিন। এই অ্যাপ এবং সফটওয়ার এখন চট্টগ্রামের বিভিন্ন ব্যাংক ব্যবহার করে কৃষকদের ঋণ দিচ্ছে।  ছবি: প্রথম আলো
কৃষিঋণ সহজীকরণ অ্যাপ তৈরি করেন মো. জসিম উদ্দিন। এই অ্যাপ এবং সফটওয়ার এখন চট্টগ্রামের বিভিন্ন ব্যাংক ব্যবহার করে কৃষকদের ঋণ দিচ্ছে। ছবি: প্রথম আলো

আবদুল হালিম হাটহাজারীর উত্তর মাদার্শা এলাকার কৃষক। চাষাবাদের জন্য তিনি একবার ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছিলেন। এ জন্য তাঁকে বারবার ব্যাংকে যেতে হয়েছিল। এ বছর তিনি আবার ঋণ নিয়েছেন কিন্তু ব্যাংকে যেতে হয়েছে একবার। গত ফেব্রুয়ারিতে ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে গিয়ে অনলাইনে নাম নিবন্ধন করে আবেদন করেন। আবেদনটি পাঠিয়ে দেওয়া হয় ব্যাংকে। পরে একদিন তাঁকে ব্যাংক থেকে টাকা নেওয়ার জন্য ফোন দেওয়া হয়। কোনো ঝক্কি-ঝামেলা ছাড়াই হালিম ব্যাংকে গিয়ে টাকা নিয়ে আসেন।

‘ঋণ সহজীকরণ সফটওয়্যার’ নামে একটি অ্যাপের মাধ্যমে কৃষকেরা এখন আবদুল হালিমের মতো সহজেই অনলাইনে ঋণের আবেদন করতে পারছেন। মো. জসিম উদ্দিন নামে অগ্রণী ব্যাংকের একজন শাখা ব্যবস্থাপক এই অ্যাপের উদ্ভাবক।

জসিম উদ্দিন চট্টগ্রামের হাটহাজারী শাখায় বসে প্রতিদিন দেখেন, কৃষিঋণ নিতে কৃষকদের কত রকম ঝক্কি। বারবার ধরনা দিতে হয় ব্যাংকে। বিষয়টি জসিমের দৃষ্টি এড়ায়নি। তিনি সফটওয়্যার বানানোর কাজে লেগে পড়লেন।

একসময় (২০১৬ সালে) সফলও হলেন। ‘ঋণ সহজীকরণ সফটওয়্যার’ তৈরি করে উপজেলা পর্যায়ে পুরস্কারও পেলেন। এরপর ইতিহাস। জসিম উদ্দিনের সেই সফটওয়্যার এবং মোবাইল অ্যাপ এখন বাংলাদেশের কৃষিঋণের মডেল।

জসিমের সফটওয়্যারটির সুবাদে অগ্রণী ব্যাংক কৃষিঋণ সহজীকরণে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের (অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন) এটুআই প্রকল্পের সঙ্গে উদ্ভাবনী প্রকল্প হিসেবে একটি চুক্তি করেছে। এটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘কৃষি ও পল্লীঋণ সহজীকরণ প্রকল্প’। প্রকল্পটির প্রতিষ্ঠাকালীন পরিচালক করা হয় জসিম উদ্দিনকে। প্রকল্পটি চট্টগ্রামে সরকারি ব্যাংকের সব শাখা এবং বেসরকারি ব্যাংকগুলোর দুটি করে শাখায় চালু হয়েছে।

এমন একটি উদ্ভাবন জসিম উদ্দিনকে দিয়েছে অনেক স্বীকৃতি ও পুরস্কার। অগ্রণী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জসিম উদ্দিনকে কানাডার টরন্টোর অগ্রণী রেমিট্যান্স হাউসের সিইও করে সে দেশে পাঠিয়েছে।

অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শামস-উল-ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘জসিমের তৈরি করা সফটওয়্যার বাংলাদেশ ব্যাংক এখন বিভিন্ন ব্যাংকে কৃষিঋণ সহজীকরণের কাজে ব্যবহার করছে। এটি একটি মডেল। কৃষিঋণের এই সফটওয়্যার ঋণদান অনেক সহজ এবং কৃষিবান্ধব করবে বলে আশা রাখি।’

যেভাবে কাজ করবে

জসিমের অ্যাপটির নাম কৃষি ও পল্লীঋণ সহজীকরণ। এর ওয়েব ঠিকানা: www.onlinekrishi.gov.bd। অ্যাপটি ডাউনলোড করে ঋণের জন্য আবেদন করতে হবে। কৃষক প্রথমে নিজে মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার করে অথবা ইউডিসির (ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার) মাধ্যমে হোম পেজে জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর ও মোবাইল নম্বর দিয়ে নিবন্ধন ফরম পূরণ করবেন। স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রেরিত কোড দিয়ে নিবন্ধন সম্পন্ন করবেন। ঋণের আবেদনের জন্য প্রবেশ বাটনে ক্লিক করে কৃষক নিজের প্রোফাইল ও অন্যান্য তথ্য হালনাগাদ করবেন।

এরপর ঋণের আবেদন ফরম পূরণ করবেন। ফরম পূরণের ক্ষেত্রে আবেদনকারী ঋণের খাত অনুযায়ী ঋণের পরিমাণ দিয়ে তাঁর নিকটস্থ পছন্দের ব্যাংকে আবেদন করতে পারবেন। দুজন জামিনদারের তথ্য পূরণ করতে হবে। চাহিদা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র স্ক্যান করে প্রেরণ বাটনে ক্লিক করতে হবে। এভাবে কৃষকের নথি চালু হয়ে যাবে এবং কৃষকের মোবাইলে একটি মুঠোবার্তা পাঠানো হবে। খুদে বার্তায় ঋণ অনুমোদন হলো কি হলো না, তা জানা যাবে। পরে কৃষক ব্যাংকে গিয়ে ঋণ সংগ্রহ করবেন। নিবন্ধনের জন্য লাগে ৫০ টাকা।

কৃষকের আবেদনটি উপজেলা কৃষি, মৎস্য প্রাণিসম্পদসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা যাচাই-বাছাই করবেন। শাখায় নিয়োজিত ঋণ কর্মকর্তা পুনরায় কৃষকের ঋণপ্রাপ্তির যোগ্যতা যাচাই করবেন। এরপর শাখা ব্যবস্থাপক চূড়ান্ত অনুমোদন করবেন।

এই পদ্ধতি ব্যবহার করে গত মার্চ পর্যন্ত চট্টগ্রাম অঞ্চলে প্রায় ১ হাজার ১০০ কৃষক ঋণের জন্য নাম নিবন্ধন করেছেন। এর মধ্যে ৬৩০ জন ঋণের জন্য আবেদন করেন। যাচাই-বাছাই শেষে ৫২৫ জনের ঋণ অনুমোদন করা হয়। প্রায় ৩ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়।

প্রকল্পের ফোকাল পারসন বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী পরিচালক রুবেল চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, এই পদ্ধতিতে ঋণদান আগের চেয়ে সহজতর হয়েছে। কৃষককে সাহায্য করার জন্য ইউডিসি রয়েছে। সব ব্যাংককে এই পদ্ধতিতে কৃষিঋণ দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত ২১টি ব্যাংক শুরু করেছে।

হাটহাজারীর কৃষক আবদুল হালিম এই পদ্ধতিতে ঋণ নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ঋণ পেতে কোনো ঝামেলা হয়নি। আগে ঋণের জন্য অনেক কিছু করতে হতো।

পেছনের কথা

জসিম উদ্দিনের বাড়ি রাউজান উপজেলায়। ২০০৫ সালে কর্মজীবন শুরু করেন রাউজানের নোয়াপাড়ার উচ্চবিদ্যালয়ের কম্পিউটার শিক্ষক হিসেবে। এক বছর পর তিনি অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেডে আইটি কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন। ২০১৫ সালে অগ্রণী ব্যাংক হাটহাজারী শাখায় শাখা ব্যবস্থাপক হিসেবে যোগ দেন। সেখানে বসেই এই সফটওয়্যার তৈরি করেন।

জসিম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘উপজেলা কৃষিঋণ বিতরণ কমিটির সদস্যসচিব ছিলাম আমি। মাসিক সভায় লিড ব্যাংকিং নিয়ে তথ্য উপস্থাপন করা হতো হাতে লেখা কাগজে। তখন আমি একটি সফটওয়্যার তৈরি করে তার মাধ্যমে উপস্থাপন করা শুরু করলাম। ঋণদানের বিষয়টি নিয়ে এমন একটা সফটওয়্যার বানালাম, যাতে কৃষককে একবার শুধু ব্যাংকে যেতে হবে। এরপর ২০১৭ সালে হাটহাজারী উপজেলায় উদ্ভাবনী মেলায় সেটা উপস্থাপন করা হলো। জুটল শ্রেষ্ঠ পুরস্কার।’

তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিব (সমন্বয় ও সংস্কার) এ এন এম জিয়াউল আলম ওই বছর হাটহাজারীতে প্রকল্পটি দেখতে যান। এরপর ২০১৭ সালে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের এটুআই প্রোগ্রামের ‘আইডিয়া ব্যাংকে’ ঋণ সহজীকরণের এ ধারণাটি জমা দেওয়া হয়। জুরিবোর্ড যাচাই-বাছাই শেষে ওই বছরই ধারণাটির স্বীকৃতি দেয়।

এরপর ২০১৭ সালের ২১ মে এটুআই প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে পাইলট প্রকল্প হিসেবে অগ্রণী ব্যাংকের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর হয়। অগ্রণী ব্যাংকের পক্ষে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শামস-উল-ইসলাম চুক্তিতে সই করেন। এ সময় উদ্ভাবক মো. জসিম উদ্দিন উপস্থিত ছিলেন।

‘কৃষি ও পল্লীঋণ সহজীকরণ’ পাইলট প্রকল্পের এলাকা ধরা হয় চট্টগ্রামের ১৫ উপজেলা। কাজের সুবিধার জন্য তিনজন ফোকাল কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়। তাঁরা হলেন জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার তৌহিদুল ইসলাম, বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী পরিচালক রুবেল চৌধুরী ও অগ্রণী ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা টুটুল বড়ুয়া।

রুবেল চৌধুরী বলেন, এ উদ্ভাবনটি সম্পূর্ণ অগ্রণী ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক জসিম উদ্দিনের। তিনি কানাডায় থাকায় এখন অগ্রণী ব্যাংক চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব শাখার ব্যবস্থাপক আনিছুল মোস্তফা প্রকল্প পরিচালক (পিডি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক সব ব্যাংককে এই পদ্ধতি অনুসরণের জন্য নির্দেশ দিয়েছে।

২০১৮ সালের ১৯ জুন বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে সব ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের উপস্থিতিতে প্রকল্পটির উদ্বোধন করেন ডেপুটি গভর্নর এস এম মনিরুজ্জামান। ২০১৮ সালের ১ জুলাই থেকে অগ্রণী ব্যাংকের ৪৩ শাখায় অনলাইনে কৃষিঋণ বিতরণ শুরু হয়। দুই মাস পর এটুআই প্রকল্প থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে সব ব্যাংকে এই পদ্ধতি চালুর জন্য নির্দেশনা দেওয়ার অনুরোধ করা হয়।

স্বীকৃতি

নিজের উদ্ভাবন এটুআই প্রকল্পভুক্ত হওয়াটা জসিমের কাছে সবচেয়ে বড় পুরস্কার ও স্বীকৃতি। এ ছাড়া উদ্ভাবনের জন্য অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেডের বোর্ড ২০১৭ সালে জসিম উদ্দিনকে প্রশংসাপত্র ও ৫০ হাজার টাকা পুরস্কার দেয়। একই বছর জেলা পর্যায়ে সেরা উদ্ভাবনের পুরস্কারও পান জসিম। এ ছাড়া জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড সামিট অ্যাওয়ার্ডসে (ডব্লিউএসএ) উদ্ভাবনটি জমা দেওয়া হয়। সেখানে বাংলাদেশের সাতটি মনোনীত উদ্ভাবনের মধ্যে পল্লীঋণ সহজীকরণ প্রকল্পটিও স্থান পেয়েছে। একটি সনদও দেওয়া হয়।